মানুষ হিসেবে আমার বাবা চমৎকার ছিলেন। আমার মায়ের ভাষায়- ভালো স্বামীও ছিলেন উনি। আর আমরা (মেয়েরা) ছিলাম উনার জান। সেনাবাহিনীতে এমন কোনো মানুষ ছিল না যে বাবার সহযোগিতা পায়নি। বাবা খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। আমার মাও ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। বাবার প্রিয় গান ছিল- যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে...। বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল উদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে এভাবেই বর্ণনা মূল্যায়ন করেন তার দ্বিতীয় মেয়ে আফরোজা জামিল কঙ্কা। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল উদ্দিন আহমেদ কর্নেল জামিল বেশি পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম জামিল উদ্দিন ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত হন জামিল। সেদিনের এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তার মেয়ে কঙ্কা বলেন, ভোর ৫টার কিছুক্ষণ আগে ফোন আসে। ফোন রিসিভ করেন মা আনজুমান আরা জামিল। ‘ফোনের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন বাবা। আমি তখন পাশের ঘর থেকে তাদের কথাবার্তা শুনি। মা বাবাকে বললেন, এই সময়ে তুমি যাবে? বাবা মায়ের দিকে বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন- কী বলো তুমি! বঙ্গবন্ধু বিপদে পড়েছেন, আমাকে ডেকেছেন আর আমি যাব না? বাবা কিন্তু তখন ডিএফআইতে (বর্তমানে ডিজিএফআই) কর্মরত ছিলেন। উনি না গেলেও পারতেন, তবে দেশের প্রয়োজনে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় তিনি গেলেন। আর ফিরে এলেন না।’১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আফরোজা জামিল কঙ্কা বলেন, আমার বয়স তখন ১২-১৩ হবে। সেদিন দুপুর দেড়টার দিকে জেনারেল শফিউল্লাহ চাচা মাকে ফোন করে বললেন, ভাবি সম্ভবত ভাই আর নেই। উনি পুরোটা বলতে পারলেন না। তখন আমরা গণভবনের ভেতরে থাকতাম। একজন সেনা কর্মকর্তা ও কিছু সেনা সদস্য আমাদের গাড়িতে করে লালমাটিয়ায় আমার চাচার বাসায় নিয়ে গেলেন। এরপর সেনা কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করে রাত প্রায় ১১টার দিকে আমার চাচার বাসায় বাবার লাশ নিয়ে এলেন। আমি চাচার বাসার উপর থেকে কিভাবে যেন নিচে নেমে গেলাম। দেখলাম গাড়ির ভেতর বাবাকে শোয়ানো। বাবার পা দুটো গাড়ির জানালা দিয়ে বের হয়ে আছে। বাবার পায়ের কাছে গিয়ে পায়ে হাত রাখতেই বুঝতে পারলাম বাবা আর নেই। (এই কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন আফরোজা জামিল)।বাবার স্মৃতিচারণ করে চোখের পানি যেন থামাতে পারছিলেন না আফরোজা জামিল কঙ্কা। অথচ বাবার লাশ নিয়ে সেদিন কাঁদতেও দেয়া হয়নি তার আদরের মেয়েদের। সেদিনের সেই ভয়ংকর অভিঙ্গতার বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে যান কঙ্কা। বলেন, বাবার সহকর্মী ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ চাচার বাসায় লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানেই গোসল করানো হয়। পরে আমাদের ডাকা হয় বাবার লাশ দেখার জন্য। তখন সেনা সদস্যরা বাবার লাশ ঘিরে রেখেছিল। আমাদের বলা হয়েছিল কেউ কাঁদতে পারবেন না। আমরা সবাই গেলাম। আমার মা তখন বাবার লাশের পাশে বসেছিলেন। কাঁদতে পারেননি। কি নির্মম! কি নিষ্ঠুর! কখনও ভাবতে পারেন বিষয়টা! আপনার বাবার লাশের সামনে যাবেন অথচ আপনার কাঁদার পর্যন্ত স্বাধীনতা নেই? আমার বড় বোন চিৎকার করে কেঁদে ফেলল। বড় আপাকে সবাই ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। রাত প্রায় ১২টার পর বাবার লাশ বনানীতে সেনাবাহিনীর কবরস্থানে দাফন করা হয়। বাবার সঙ্গে কাঠানো সেই দিনগুলো এখনো খুব মনে পরে কঙ্কার। বাবাই তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন রং-তুলি। সেই রং তুলিতে আঁকা ছবিগুলো এখনো খুঁজে বাবাকে। কঙ্কা বলেন, সেনা কর্মকর্তা হলেও বাবা দায়িত্বের বাইরে যতটুকু সময় পেতেন আমাদের দিতেন। সব সময় খুব হাসিখুশি থাকতেন। রোববার ছুটির দিনে সকালবেলায় আমার মা মজার নাস্তা বানাতেন আর আমরা সবাই মিলে নাস্তা খেয়ে বাবার সঙ্গে আমাদের নিশান প্রিন্স গাড়ি পরিষ্কার করতাম। বাবা যখন কাজে ব্যস্ত থাকতেন তখন মাঝেমধ্যে আমাকে বলতেন, মা আমার পিঠটা চুলকে দাও তো। তখন আমি নখ দিয়ে বাবার পিঠে বিভিন্ন ছবি আঁকতাম আর জিজ্ঞাসা করতাম- বলো এটা কিসের ছবি? ওই মুহূর্তগুলো খুব মনে পড়ে।বাবাকে হারালেও এখনো বাবার আদর্শ নিয়েই পথ চলার চেষ্টা করছেন তার এই মেয়ে। বাবার কাছ থেকে পাওয়া দায়িত্বশীলতা ও নিষ্ঠার শিক্ষা নিয়েই জীবনের পথচলার পথেও নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেন, আমি একজন চিত্রশিল্পী। বাবা প্রায়ই বলতেন, আমার মেয়েকে আমি প্যারিসে পাঠাব। শহীদ পরিবারে হিসেবে সরকার থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা না পেলেও তাতে খুব বেশি আক্ষেপ নেই জামিল কন্যার। তার মতে, শহীদ পরিবার হিসেবে আমরা কিছুই পাইনি। আমার মা একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী থেকে পরে ব্যবসায়ী হয়েছিলেন। মা ১৯৯৬ সালে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার সংসদ সদস্য ছিলেন। মা আমাদের চার বোনকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। নিজের জন্য কিছু চাওয়ার নেই। ওই হত্যাকাণ্ডের যে বিচার হয়েছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তবে সবার দণ্ড এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। দণ্ডপ্রাপ্ত যারা এখনো বিভিন্ন দেশে আছে, তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হোক। ডিজিএফআইয়ের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করেছেন। এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কর্নেল জামিল ও আনজুমান আরা জামিলে সংসারে চার মেয়ে। বড় তাহমিনা এনায়েত ঢাকায় থাকেন। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। ২ ছেলে ও ২ মেয়ের সংসার তার। আফরোজা জামিল কঙ্কা- চিত্রশিল্পী। ২ ছেলে ও স্বামীর সংসার তার। সেজো ফাহমিদা আহমেদ আমেরিকায় থাকেন। সেখানে ব্যবসা করছেন। সবার ছোট বোন ক্যারিশমা জামিল দেশেই থাকে। সেও পেশায় আর্টিস্ট। এক মেয়ে নিয়ে তার দিনগুলো ভালো কাটছে।বর্তমান প্রসঙ্গে আফরোজা জামিল কঙ্কা বলেন, আমরা চার বোন ভালোই আছি। সরকার থেকে আমার মাকে কিছুই দেওয়া হয়নি। আমরা শুধু বাবার স্বীকৃতি হিসেবে যদি সরকার কিছু করে সেটাই চাইব। আমার মা আনজুমান আরা জামিল ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে মারা যান। উনি বেঁচে থাকতে কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ নামে একটি ফাউন্ডেশন করেছিলেন। এই ফাউন্ডেশনটি চালানোর জন্য সরকারের সহযোগিতা চাইব। আর যদি ক্যান্টনমেন্টে বাবার কোনো মুর্যাল ও ইতিহাস হিসেবে বাবাকে নিয়ে কোনো গল্প পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করা হয়- এগুলোই সরকারের কাছে চাইব। এর বেশি কিছু নয়।এইউএ/জেএইচ/এসএইচএস/পিআর
Advertisement