বিশেষ প্রতিবেদন

ডাক্তারের ছড়াছড়ি : কে আসল কে নকল!

রাজধানীসহ সারাদেশে ডাক্তারের ছড়াছড়ি। এদের কে আসল আর কে নকল তা চেনা দূরহ হয়ে পড়েছে সাধারণ রোগীদের। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে এমন তথ্যই জানা গেছে।  অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে কথিত ডাক্তার তৈরির অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। তাদের কেউ এক বছরের মধ্যেই ডাক্তার বানানোর নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। আবার কেউ ২০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটের মধ্যেই দাঁত, কান, পেট ব্যাথা এবং হাঁপানি রোগ সুস্থ করার চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করছেন। কেউবা মরণব্যাধি ক্যান্সার, বিকল কিডনিসহ নানা জটিল রোগ চিকিৎসায় সারিয়ে তোলার গ্যারান্টি দিচ্ছেন। আবার কেউ নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে প্রেসক্রিপশন ও ভিজিটিং কার্ডে নামের আগে ডাক্তার লিখছেন। অনেকে সাধারণ অসুখেও দিচ্ছেন নানা পরীক্ষ আর অপ্রয়োজনীয় ওষুধ।  এদিকে, বিএমডিসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু মনিটরিং ও সুপারভিশনসহ যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় সাধারণ মানুষ অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ থাকলেও বিএমডিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা তা অস্বীকার করছেন। বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা. জাহেদুল হক বসুনিয়া জানান, মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ এর ১২৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ২৯ নং আইন মোতাবেক নূন্যতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রী প্রাপ্তগণ ব্যতীত অন্য কেউ নামের আগে ডাক্তার পদবী ব্যবহার করিতে পারবে না। তবে গত ২৩ জুলাই ফেনী সদরের লেমুয়া ইউনিয়নের উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সাকমো) রবীন্দ্রনাথ দত্তকে সাধারণ ক্ষেত্রে দলগতভাবে জনপ্রশাসন পদক-২০১৬ প্রদান করা হয়। তার নামের আগে ডাক্তার লেখা সম্মাননাপত্রে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর রয়েছে। এমবিবিএস বা বিডিএস পাশ না করেও একজন সাকমোকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির স্বাক্ষরিত পদক দেয়া নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি নবীণ চিকিৎসকদের পক্ষে ডা. সুব্রত ঘোষ এ বিষয়ে বিএমডিসির সভাপতি অধ্যাপক ডা. শহীদুল্ল্যার কাছে চিঠি দেন।  ডা. সুব্রত ঘোষ বলেন, বিএমডিসির স্বীকৃত ডিগ্রিপ্রাপ্ত না হয়েও অনেকে নামের আগে ডাক্তার শব্দটি জুড়ে পেশাকে কলুষিত করছেন। এ ব্যাপারে তারা চিকিৎসক নেতাদের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ প্রসঙ্গে বিএমএ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, বিএমএর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। সাকমোরা যেহেতু স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরাধীন সরকারি কর্মচারি সেহেতু তারা যেন আইন ভঙ্গ না করে সেদিক মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরকে সতর্ক দৃষ্টি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।  এদিকে, দেশের প্রচলিত আইনে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ও বিডিএস পাস করা চিকিৎসকদের স্বীকৃতি প্রদানকারি একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। তবে জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর ৮০/১ সিদ্ধেশ্বরী মালিবাগ মোড়ে সিটি ব্যাংকের নবম তলায় বিএমডিসির আদলে বাংলাদেশ কম্বাইন্ড মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিসিএমডিসি) নামের একটি প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে।ডাক্তারি কোর্সে ভর্তি চলছে শিরোনামে সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিসিএমডিসির অধীনে অলটারনেটিভ পদ্ধতিতে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মাধ্যমে এমবিবিএসসহ (এএস) বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি চলছে।প্রতিষ্ঠানটির ভিসি ডা. আবদুল গণি জানান, এ প্রতিষ্ঠান থেকে এমবিবিএস পাস করে সরকারি চাকরি করা যাবে না। তবে প্রতিষ্ঠানটি সরকার অনুমোদিত। রাশিয়া ও কানাডার সঙ্গে তাদের এফিলিয়েশন রয়েছে। তিনি আরো জানান, সপ্তাহে এক থেকে পাঁচদিন ক্লাস। একদিন ক্লাসের চার্জ ২ লাখ ও পাঁচদিন ক্লাসের চার্জ ৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ কেউ যদি সপ্তাহে এক দিনও ক্লাস করেন তাহলেও তিনি ডাক্তার হতে পারবেন।এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান (তিনি নিজেও বিএমডিসির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সক্রিয় নেতা) বলেন, বিএমডিসির ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা নেই। যারা ভুয়া ডাক্তার তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হবে।  অপরদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে পানি পড়া, ডাব পড়া’র মতো অপ চিকিৎসা প্রবলভাবে ঝেঁকে বসেছে। অভিযোগ রয়েছে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট (ডাক্তার নন) বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন তাদের কর্মসূচির পোস্টারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট নেতাদের নাম ব্যবহারের পাশাপাশি নিজের নামের আগে ডাক্তার কথাটি উল্লেখ করছেন। এছাড়া একই নাম বা কাছাকাছি নামের লাইসেন্স নিয়ে চলছে একাধিক ক্লিনিকও।শুধু কথিত ডাক্তাররাই নন, খ্যাতনামা ডাক্তাররাও (বিএমডিসির স্বীকৃতি নয়) এমন ডিগ্রি ব্যবহার করে মানুষকে অহরহ প্রতারিত করছেন। আবার বিদেশে এক দুই সপ্তাহের সেমিনারে যোগ দিয়ে যে সার্টিফিকেট পাচ্ছেন সেটা প্রেসক্রিপশন ও ভিজিটিং কার্ডে জুড়ে দিচ্ছেন। ফলে ডিগ্রি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় সাধারণ রোগীরা প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।   বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ভিসি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, গ্র্যাজুয়েট ছাড়া অন্য কেউ নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারে না। কিন্তু অনেকে তিন থেকে ছয়মাসের ট্রেনিং নিয়ে নামের আগে ডাক্তার লিখছে। ফলে অসংখ্য মানুষ অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিএমএ এমনকি গণমাধ্যমকর্মীদের শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত।  জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন কমিটির সভাপতি ও বিএমএ’র সাবেক সভাপতি অধ্যাপাক ডা. রশীদ ই মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, সারাদেশে অসংখ্য মানুষ অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। তবে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব বিএমডিসির। এছাড়া সাধারণ মানুষকে অপচিকিৎসা থেকে রক্ষা করতে চিকিৎসক নেতাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এম মোজাহেরুল হক বলেন, বিশ্বের অন্য কোন দেশে ডিগ্রিধারী ছাড়া কেউ রোগীর চিকিৎসা করতে পারে না। দেশে সাকমো ও এলএএমএফসহ বিভিন্ন স্বল্প মেয়াদে ডিগ্রিপ্রাপ্তরা সহায়ক হিসেবে চিকিৎসা প্রদান করছে। তবে চিকিৎসক সহায়ক হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ডিগ্রি প্রদান করছে তাদের নিয়মিত মনিটর ও সুপারভিশন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে করতে হবে।  অন্যথায় এর কুফল সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর পড়বে।  বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা. জাহেদুল হক বসুনিয়া বলেন, সম্প্রতি বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত ৮২ হাজার ৫০০ চিকিৎসকের (এমবিবিএস ও বিডিএস) তালিকা প্রকাশ হয়েছে। দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কেউ চিকিৎসক রেজিস্টার্ড কিনা তা জানতে পারবেন।  তিনি আরো বলেন, বিএমডিসি অভিযোগ না পেলে কোন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে রোগীদের সচেতন হয়ে অপচিকিৎসকের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণসহ অভিযোগ করার আহ্বান জানান তিনি। এমইউ/এএইচ/এমএস

Advertisement