রাষ্ট্রযন্ত্র আবারো প্রমাণ করলো আইন সকলের জন্য সমান নয়। এখনো ধনিক শ্রেণির জন্য আইনের ব্যবহার এক রকম আর গরিবের জন্য আরেক রকম। বছর দুয়েক আগে বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরডটকমে লিখেছিলাম জালিয়াত সচিবদের আইনের আওতায় আনা হোক। ওই সচিবরা মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাময়িক সনদ দিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়াতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। অথচ সেই সময় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের ভুয়া সনদ দিয়ে নিয়োগ পাওয়া ২৩ প্রশিক্ষণরত কনস্টেবলকে নোয়াখালী পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এবার দেখলাম ভুয়া সনদ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ সোমবার ১৯ জনকে পাবনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলায় আসামী এমন ২০ জনের বাবাকেও আসামি করা হয়। অপরদিকে সচিবদের অবসরে পাঠানো হয়েছে। আর একজনকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় একটি কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। অর্থাৎ একই অপরাধে একদল যায় কারাগারে আরেক দল পায় পদোন্নতি। একদল নিজে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। আরেক দল নিজেদের পিতাদের মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়েছেন। দুটিই অপরাধ। এক দলের উদ্দেশ্য বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচাতে কয়েক হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে প্রবেশ করা। আরেক দলের উদ্দেশ্য চাকরিজীবনের শেষপ্রান্তে নিজেদের শান-শওকত আরও এক বছর বাড়িয়ে নেওয়া। একদল শিক্ষিত (?), আরেক দল তেমন পড়াশোনা করেননি বা সুযোগ পাননি। অথবা রাষ্ট্র সে সুযোগ করে দেয়নি। একদল খুবই গরীব, যাদের দুবেলা খাবার জোটে না। আরেক দল ধনী, সমাজের উঁচুস্তরে তাদের বসবাস, সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা তারা। মোটা দাগে পার্থক্য এ রকমই। কিন্তু রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে এ দুটি দলের মধ্যে ব্যবধান অনেক। পার্থক্যও বিশাল। গরিব দলটিকে রাষ্ট্র একেবারে জেলে পুরে দিল। আর ধনীক শ্রেণির প্রতিনিধিদের টিকিটি পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখলো না। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকার বিষয়ে ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” এক্ষেত্রে সংবিধান যারা প্রতিপালন করেন তারা স্পষ্টতই তা লংঘন করে আমলা অর্থাৎ ধনীদের পক্ষ নিয়েছেন। আর যে দুর্নীতি দমন কমিশন ওই শিক্ষানবিশ কনস্টেবলদের ধরে এনে বাঘের বাচ্চার মত আচরণ করছে সেই কমিশনই যেন সচিবদের ক্ষেত্রে বিড়ালের বাচ্চা হয়ে গেল। তারা ওই সচিবদের কোমরে দড়ি বাঁধাতো দূরের কথা তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে এক পা’ও এগুলো না। যে অপরাধে কনস্টেবলদের কারাগারে পাঠানো হলো সেই অপরাধতো সচিবদের ক্ষেত্রে প্রমাণিতই ছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এই কর্মকর্তাদের সনদ বাতিল করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়ে বলেছে,তারা মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। তারা সরকারি নির্দেশনা, পরিপত্র ও আইন অমান্য করে অসদাচরণ করেছেন। অর্থাৎ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত। তারা সরকারি চাকরির বিশ্বাসভঙ্গও করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র দুই বছরেও কোন ব্যবস্থা না নিয়ে আমলাতন্ত্র ও ধনিক শ্রেণির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। কারণ যারা পেটের দায়ে নিজেদের পিতাদের মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে কয়েক হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরি জোগাড় করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করে কারাগারেও পাঠানো হয়েছে, বিচার চলছে। আর সচিবরা বহাল তবিয়তে সমাজে অবস্থান করছে। ওই সচিবরা যে অপরাধ করেছেন, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি অনুযায়ী, ৪২০ ধারায় প্রতারণা এবং ৪৬৮ ধারায় জালিয়াতির মামলা হওয়া জরুরি ছিল। এসব ধারায় সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সরকারি চাকরির শীর্ষপদে থেকে মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভুয়া সনদ জোগাড় করে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ নেওয়ায় তাদের সর্বোচ্চ সাজাই হওয়া উচিত। আর যেন এমন উদাহরণ কেউ তৈরি করতে না পারেন সেজন্য তাদের শিগগিরই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। ওইসব জালিয়াত সচিবরা শুধু ফৌজদারি অপরাধই করেননি, তারা মুক্তিযুদ্ধেরও অপমান করেছেন।জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই ভুয়া সনদ প্রদান প্রক্রিয়ায় যুক্ত সকলকেই আইনের আওতায় আনা উচিত ছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই পক্ষপাতিত্ব একটি কলঙ্কজনক উদাহরণ হিসেবেই থেকে যাবে। লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজএইচআর/পিআর
Advertisement