গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলা এবং কল্যাণপুরে জাহাজ বাড়িতে জঙ্গিবিরোধী অপারেশন স্টর্ম ২৬-এর পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন এক মোড় নিয়েছে। বিশেষ করে জঙ্গিবাদবিরোধী একটি জাতীয় ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। এমনকি বিশ্ব নেতৃবৃন্দও বাংলাদেশের জঙ্গিবাদবিরোধী এই অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে দুঃখজনক হচ্ছে আমাদের দেশের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ জঙ্গি ইস্যূতে এমনসব কথা বলছেন যা মোটেও কাঙ্খিত নয়। দেশ যখন কোনো ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে তখন দলমত নির্বিশেষে সকইলেই এক কাতারে শামিল হন। এটাই দেশপ্রেম। এটাই দায়িত্বশীলতা। কিন্তু আমাদের দেশে এক্ষেত্রে উল্টোটাই দেখা যায়। জাতীয় স্বার্থেও রাজনৈতিক লাভালাভের বিষয়টিই মুখ্য হয়ে ওঠে। যদিও সব কিছু হয় গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে। কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও নিজেরা কতোটা গণতান্ত্রিক এই হিসেব কেউ করেন কিনা সন্দেহ। গণতন্ত্র একটি বিকাশমান ধারা। গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়েই তা বিকশিত হয়। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পরও আমাদের দশে গণতন্ত্র কতোটা বিকশিত হয়েছে সে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চর্চার ব্যাপারে কতোটা আন্তরিক সেটাও বিবেচ্য বিষয়। চর্চার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। আর এতে প্রধান ভূমিকা থাকে রাজনৈতিক দলগুলোরই। এ জন্য রাজনৈতিক চর্চায় গণতন্ত্রের উপাদান অবশ্যই থাকতে হবে। এবং তা শতভাগ। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতেই একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়। পরস্পরের প্রতি আস্থা বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। নেতানেত্রীদের সম্মিলিত আচরণই আসলে সেই সমাজ বা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিকশিত করতে সহায়তা করে। কাজেই নেতা-বা নেত্রীর একক আচরণও এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ নেতানেত্রীদের আচরণ দ্বারা অন্যরাও উৎসাহিত হন। সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হোক না কেন। এ জন্য তাদের আচরণের মধ্যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় থাকতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরমতসহিষ্ণুতা এবং পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাষাতেও রয়েছে শিষ্টাচারের অভাব। কে কার চেয়ে বড়, কিংবা কাকে কিভাবে ছোট করা যায় সব সময় এই ধরনের অসহিষ্ণু মানসিকতার বহির্প্রকাশ দেখা যায় অনেক রাজনীতিবিদের কথাবার্তায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক একটি সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও মানসিকতা কোন অবস্থায়ই কাম্য নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াই আসলে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমাদের দেশে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের চর্চা যত বাড়বে গণতন্ত্রের ভিত্তি ততই মজবুত হবে। প্রসঙ্গত, ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করতে হয়। তিনি বলেছিলেন, আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকারের জন্য জীবনও দিতে পারি।’গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এই ধরনের মানসিকতা প্রদর্শন করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বৈরিতাপূর্ণ সমাজে বাকসংযম এবং তাতে শালীনতা রক্ষা একান্ত অপরিহার্য। দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কথাবার্তায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন এমনটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝেমধ্যেই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। এবং তা প্রায়শই ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি পর্যন্ত গিয়ে গড়ায়।দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ প্রায়ই একে অপরের প্রতি উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন। কথার ফানুস উড়িয়েই চমক সৃষ্টি করতে চান। জনসভায়, কিংবা টিভি টকশোতে জনতার হাততালি কুড়াতে অনেকেই কথার লাগাম টানতে চান না। এতে কেউ কৌতুক বোধ করেন, কেউ বা সস্তা আমোদও পান। কিন্তু বক্তার ব্যক্তিত্ব যে এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেটি কি সংশ্লিষ্টরা বুঝতে অক্ষম?বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক নেতা এমন ভাষায় কথা বলছেন যাতে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বালাই নেই। রাজপথ কী সংসদ, জনসভা, কী টেলিভিশন টকশো কোথাও তারা কম যান না। বাকপটুতা প্রদর্শন করতে গিয়ে এমন সব প্রসঙ্গের অবতারণা করেন যা অবান্তর এবং ব্যক্তিগত রেষারেষি, চরিত্রহনন ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব অসার তর্জন-গর্জনে আসলে দেশ ও জাতির কোন উপকার হয় না। বরং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে জঙ্গিবাদের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে কথা বলার ক্ষেত্রে অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে, এমনকি অনেক সময় তা কৌশলাশ্রয়ীও হবে। কিন্তু তার মধ্যেও একটি সুস্থতা, মানবিকতা এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বক্তব্য হবে ধী শক্তিসম্পন্ন। মানুষজন বিশেষ করে ভবিষ্যত প্রজন্ম তা থেকে শিখবে। জ্ঞানার্জন করবে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের মতো নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি এখনও জাতিকে নতুন দিশা দেয়। তাই রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে এমন বিষয় থাকা উচিত যা অনুসরণযোগ্য, প্রেরণামূলক ও জনকল্যাণকর। আসলে বক্তব্য কতোটা সারবত্তা হল সেটাই দেখার বিষয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অনেক কথা যাও যে বলি কোনো কথা না বলি’। না বলেও তো অনেক কিছু বোঝানো যায়। সেই বাকপটুতা এবং শৈল্পিক বোধটুকু থাকা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে রাজনীতিও একটা আর্ট বা শিল্প। সংশ্লিষ্টদের এক্ষেত্রে সেই শিল্প মনস্কতার পরিচয় দিতে হবে। তবেই রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। এরফলে জঙ্গিবাদ দমনও সহজ হবে। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্টএইচআর/এমএস
Advertisement