বিএনপি নামক রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটি নিয়ে যতো কম কথা বলা যায় ততোই উত্তম। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই দলটির প্ল্যাটফরমটিকে কেন্দ্র করে বলার মতো কথার বা বিষয়বস্তুর যে অভাব হয় না, তা রাজনীতির পর্যবেক্ষক বা বিশ্লেষক মাত্রেই জানেন। এমনিতে নিস্ক্রিয়, জনগণ থেকে বহু দূরে ছিটকে পড়া এই রাজনৈতিক দলটি বাংলাদেশে একটি আওয়ামী-বিরোধী প্ল্যাটফরম দরকার বলেই আছে, নাহলে দৃশ্যতঃ তাদের কোনো হেল-দোল নেই। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি ষড়যন্ত্রের কথা বলেন, গোপনে রাজনীতির কোপ-এর কথা বলেন, তাহলে দেখতে পাবেন এই প্ল্যাটফরমটির ষোলআনা উপস্থিতি। একথা বহুবার লিখেছি যে, বিএনপি এবং জামায়াত আসলে দুই নামে একই সংগঠন। এখনও এই দুই নামে একই সংগঠন চালানোর কোনো প্রয়োজন আছে কিনা সেটি ভেবে দেখা প্রয়োজন। হঠাৎ করে জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্কুলে (আমি রাজনীতির স্কুলের কথা বলছি) প্রভাষক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এমাজউদ্দিন আহমেদ বলে বসলেন যে, তিনি তার নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তিনি জামায়াত থেকে বিএনপিকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে ঐকমত্যে (?) পৌঁছেছেন। কিছুদিন আগে এক ডাক্তার ভদ্রলোকও এই কথা বলার চেষ্টা করে রাজনৈতিক উষ্টা খেয়েছেন। কিন্তু এমাজউদ্দিন সাহেব এই বৃদ্ধকালে যে “বাড়িটি” খেয়েছেন তা তুলনাহীনই কেবল নয়, বরং বাঙালি জাতি যে বৃদ্ধকে সম্মান দিতে শেখেনি তাও প্রমাণিত হয়েছে। নাহলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এভাবে সংবাদ সম্মেলন করে কেন বলতে হবে যে, জামায়াত প্রসঙ্গে এমাজউদ্দিন সাহেব যে কথা বলেছেন সেটা দলের বা নেত্রীর বক্তব্য নয়, বরং তার নিজস্ব মস্তিস্ক প্রসূত। এরপর এমাজউদ্দিন সাহেব আর কী করবেন? মিন মিন করে বলতে চাইলেন যে, তার বক্তব্য বিকৃত করেছে মিডিয়া, তিনি একথা বলতে চাননি, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তিনি এখনও এই কথাটি দৃঢ়ভাবে বলার সক্ষমতা অর্জন করেননি যে, বিএনপি কেন জামায়াত-এর সঙ্গ ত্যাগ করবে? কোন কারণ? বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল বলে? ভেবে দেখুনতো, স্বাধীনতার ঘোষণার তারিখ বদলানো, সেনা বাহিনীতে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হত্যা, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী জামায়াতকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা এবং সর্বশেষ বেগম জিয়ার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরও দলটি কী ভাবে মুক্তিযুদ্ধের দল হিসেবে বহাল থাকে? কিংবা যখন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে, মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যেতে হবে (এমাজউদ্দিনের বক্তব্যের পরে যেমন মির্জা সাহেব সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন তেমন করে কিন্তু বিএনপি’র পক্ষ থেকে খন্দকার মাহবুবের বক্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি), তখনও কি বলতে হবে যে, বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল এবং স্বাধীনতা বা ১৯৭১ নিয়ে দলটির বিন্দুমাত্র কোনো উপলব্ধি আছে? নাকি অতি সম্প্রতি যখন জাসদ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় তখন বিএনপি নেত্রীর একটি কথাকে আমাদের বিএনপি’র মূল বক্তব্য হিসেবে ধরে নেওয়া উচিত? তিনি বলেছেন যে, ১৯৭১ সালেতো বিএনপি’র জন্মও হয় নাই। আমার মনে হয়, এটাই সত্য এর বাইরে বাকি সব কিছু মিথ্যে। কিন্তু তারপরও যারা বিএনপি, মুক্তিযুদ্ধ ও জামায়াত-এর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী তাদের জন্য আরো একটু আলোচনা করা যাক। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি’র অবস্থান দেখুন একবার। দালাল আইন বাতিল করে জিয়াউর রহমান প্রথমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পথ রুদ্ধ করেন যদিও বিএনপিপন্থী বোদ্ধারা মিথ্যাচার করবেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই “সাধারণ ক্ষমা” ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ইত্যাদি সকল পদ ও প্রয়োজন মেটাতে বিএনপি কিন্তু বার বার ছুটে গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-বিরোধী রাজাকারদের কাছে। কতোজনের কথা বলবো, শাহ্ আজিজ, আব্দুল আলিম, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, সাকা চৌধুরী, লিস্ট অতি দীর্ঘ। ২০০৯ সাল থেকে দলটির কাজকারকার দেখুন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই তবে কিন্তু ইত্যাদি বলেই কিন্তু দলটি তাদের দায় ও দায়িত্ব শেষ করেনি তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মিলে দেশে একটা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছিল। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ’র বিরোধিতায় প্রথমে হেফাজতকে মাঠে নামিয়েও যখন কাজ হলো না তখন ব্লগারদের বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সোচ্চার তরুণদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে বেছে বেছে তাদের ধর্মকে নিয়ে লেখাগুলো সংবাদপত্রে ছাপিয়ে দেশের ভেতর একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল কারা? সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে বেগম জিয়া কাদেরকে “নাস্তিক” এবং “নষ্টছেলে” আখ্যা দিয়েছিলেন? মাহমুদুর রহমানের সম্পাদনায় আমার দেশ পত্রিকায় কতিপয় ব্লগারদের ধর্ম নিয়ে লেখাগুলি প্রকাশ করার উদ্দেশ্য কী ছিল? মজার ব্যাপার হলো, ব্লগ বা ব্লগার কী জিনিস তা কারোরই জানা ছিল না, ২০০৬ সাল থেকে বাংলা ব্লগে যারা লেখালেখি করতেন তাদেরকে কিন্তু চাপাতি/বন্দুক নিয়ে হত্যা করতে যায়নি, ব্লগার রাজিব হত্যাকাণ্ড তখনই ঘটেছে যখন তার লেখাগুলি ব্লগ থেকে সংবাদপত্রের পাতায় তুলে ধরা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, আমার দেশ যারা পড়েন তারা আসলে সেই সব মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধকে মনে করেন ইসলামের পরাজয়, ফলে এই প্রচারণার সুফল পেতে সময় লাগেনি, দেশে নতুন করে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। চাপাতি দিয়ে শুরু করে শেষ পর্যন্ত হোলি আর্টিজানে দেশি-বিদেশি হত্যার ঘটনা পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু শুরুটা ছিল কিন্তু বিএনপি’র উস্কানিতেই। ঠিক আছে, আমার ওপরের বক্তব্যের সঙ্গে যদি কেউ একমত না হন তাহলে একবার তাকিয়ে দেখুন বিএনপি’র নবগঠিত কমিটির দিকে। কী দেখতে পান? যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারদের পরিবারের সদস্যদের দেওয়া হয়েছে বিশেষ সুবিধা এবং পদ। যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার পরেও কেমন করে তাদের ছানাপোনাদের দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়? কিন্তু কে জিজ্ঞেস করবে এ কথা? গতকাল যতোগুলো টক শো হয়েছে তার বেশিরভাগটিতেই দেখা গেছে এই কমিটি নিয়ে আলোচনা কিন্তু এই প্রশ্ন উত্থাপনের সৎসাহস কারো হয়নি। কারণ, বাংলাদেশে এখনও বিএনপি যা করে তা নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার কারোরই নেই। দু’একজন মিহি সুরে বলতে চেয়েছেন যে, গণতন্ত্র চাই গণতন্ত্র চাই বলে চেঁচিয়ে দলীয় কমিটি নির্বাচনে কেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি? খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন কিন্তু অত্যন্ত হাস্যকর। রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের কোনো রীতি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাইনি। আর জিয়াউর রহমানের সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দল বিএনপি অতীতেও যা করেনি, এখন সেটা করে দেখাবে, তা ভাববার মতো কোনো মিরাকল কি ঘটেছে? ঘটেনি। কিন্তু প্রশ্ন আসলে সেটা নয়, প্রশ্ন হলো, বিএনপিকে কেন আমরা জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই? কিংবা কারা এই অকল্পনীয় কাণ্ডটি নিয়ে প্রায়শঃই আশাবাদী হয়ে ওঠেন? এবং কেন?আমার মনে হয় বিষয়টির একটা স্থায়ী সুরাহা দরকার এবং বার বার এই প্রশ্ন তোলাটাও যে বিরক্তিকর সেটাও যারা প্রশ্নটি তোলেন তাদের বোঝা উচিত। আগেই বলেছি যে, বিএনপি কেন জামায়াতকে ত্যাগ করবে? দল দু’টির প্রধান শত্রু কে? কে আবার আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা। দলটির মৌলিক চাহিদা কি? ক্ষমতা। দল দু’টি কীভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়? ধর্ম ও ষড়যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে। দল দু’টির মূল সমস্যা কী নিয়ে? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কেন? কারণ দু’টি দলেরই অতীত ও বর্তমান হলো মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধিতার ইতিহাসে ভরা। কারা এই দু’টি দলের নেতৃত্ব দেন? মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধিরা। দু’টি দলেরই তহবিল কোত্থেকে আসে? প্রমাণিত সত্য হলো পাকিস্তান ও সৌদী আরব এবং দেশের ভেতর জামায়াতী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে। ভোটের হিসেবে দু’টি দলের আলাদা কোনো অবস্থান আছে কি? নেই, জিয়াউর রহমান খুব হিসেব কষেই এদেশে জামায়াতকে ফিরিয়ে এনে রাজনীতির সুযোগ দিয়েছিলেন, উনি জানতেন যে, বাংলাদেশে একা বিএনপি’র পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব নয়, বিএনপি’র আপাতঃ গণতান্ত্রিক চেহারা যতোই উন্মোচিত হবে ততোই মানুষের কাছ থেকে দলটি দূরে সরে যাবে আর তখনই প্রয়োজন হবে পেশি শক্তি ও ধর্মীয় উন্মাদনার, যে কাজটি অতীতে ও বর্তমানে জামায়াত-শিবির অত্যন্ত সুচারূভাবে সম্পন্ন করতে পারে বলে প্রমাণ রয়েছে। আরো অনেক কারণ দেয়া যাবে বিএনপি ও জামায়াতের একত্রিত হয়ে রাজনীতি করার কিন্তু তাতে লেখার কলেবর বাড়বে কেবল। অতএব, আমার মূল কথা হলো, এই দল দু’টি যারা আলাদা দেখতে চান তারা আসলে এদেশের রাজনীতি হয় বোঝেন না, না হয় তারা রাজনৈতিক ভাবে উচ্চাভিলাষি। সোনার পাথরবাটি কল্পনায় সম্ভব, কিংবা কাঁঠাল দিয়ে আমসত্ত্ব বানানোর মতো হয়তো কিছু একটা হলেও হতে পারে কিন্তু শেষাবধি বিএনপি জামায়াতের এবং জামায়াত আসলে বিএনপির’ই; এর বিকল্প কোনো সত্য নেই। আমি এই রাজনৈতিক সম্পর্কের ভেতর কোনো খারাপ কিছু দেখি না বা একে অন্যায়ও মনে করি না। বরং এতে সবচেয়ে বড় যে সুবিধা তাহলো বাকি রাজনৈতিক দলগুলো যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধপন্থী মনে করে তাদের পক্ষে সজাগ থাকা ও রাজনৈতিক স্ট্রাটিজি নির্ধারণ সহজতর হয়ে যায়। প্রকাশ্যে বিএনপি-জামায়াত ঐক্য ভেঙে যাওয়া আর গোপনে দল দু’টি একসঙ্গে দেশ ও স্বাধীনতা-বিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়াটা যে কী পরিমাণ ভয়ঙ্কর তাতো আমরা দেখেইছি, অতএব এদের প্রকাশ জোট থাকাটা বরং মন্দের ভালো। ঢাকা ৭ আগস্ট, রবিবার ২০১৬লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্টএইচআর/এমএস
Advertisement