জাগো জবস

সন্তুষ্টির নামই সফলতা

আমরা সবাই সফল হতে চাই! কিন্তু সফলতা আসলে কী? চারপাশ দেখে মনে হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকুরে, কাড়িকাড়ি টাকা, গাড়ি, ফ্ল্যাট, বাড়ি, ব্যাস, এই তো সফলতা? ও কুড়ি হাজার টাকা বেতন পায়, আমাকে পঁচিশ পেতে হবে, ওর ওটার চেয়ে আমার এটা ভালো হতে হবে, এটাই তো সফলতা? কম্পেয়ারিজন? পরশ্রীকাতরতা? তুলনামূলক প্রতিযোগিতায় ভালো হতে হবে? কিন্তু এই তুলনার, পরশ্রীকাতরতার কি শেষ আছে?অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, জীবনের সকল বস্তুগত প্রাপ্তির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করা মানুষটিও যখন প্রবল হতাশায় রাতে ঘুমাতে পারেন না, জগতসংসারের সব কিছুই বিস্বাদ লাগে, দুম করে একদিন সুইসাইড করে বসেন। তখন? তখন কি মনে হয় না যে সফলতা আসলে এইসব কিছু নয়। সফলতা আসলে অন্যকিছু! অন্যকিছু!সেই অন্যকিছু কি? শৈশব-কৈশোর থেকে গাড়ি, বাড়ি, টাকা, সফলতার এই মানদণ্ড আমাদের শেখানো হয়। বুঝানো হয় সফলতার সংজ্ঞা এই। কিন্তু আমি বলি, সফলতা আসলে সন্তুষ্টি। স্যাটিসফেকশন! পরশ্রীকাতরতাহীনতা।ইউনিভার্সিটি জীবনের এক বন্ধু, তুমুল মেধাবী। মেধাবী আর সব বন্ধুরা যখন হায়ার স্টাডি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বড় চাকুরে হবার তুমুল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তখন সে নির্বিকার। আমি বললাম, ‘কি ব্যাপার? তোমার কোন লক্ষ্য নেই?’ সে হাসে, ‘আছে’।‘কি?’‘যে মেয়েটিকে ভালোবাসি, মাস্টার্স শেষেই তাকে বিয়ে করে গ্রামে কোথাও এনজিওর চাকরি নিয়ে চলে যাব। যতদিন ভালো লাগবে, সেখানেই থেকে যাব।’তার সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কত হাসাহাসি, টীকাটিপ্পনী, আঁতেল উপাধি। কিন্তু তারও বহুবছর পর তার সাথে দেখা, ‘কি খবর? কেমন আছ?’সে ঝলমলে হাসিতে বলল, ‘হ্যাঁ, ভালো।’আমি বললাম, ‘কোথায় আছ?’‘যেখানে থাকার কথা ছিল।’‘কোথায়?’‘সেই অজানা-অচেনা গাঁয়ে।’আমি হঠাৎ থমকে যাই, ‘সেখানেই আছো?’সে মাথা নাড়ে। তার ঝলমলে মুখ জানান দেয়, সে ভালো আছে।সেই দিন আমার হঠাৎ মনে হল, আমি এক আপাদমস্তক সুখী, তৃপ্ত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। একজন সত্যিকারের সফল মানুষ। কিন্তু আমার চারপাশের সেই দিনের আর সব বন্ধুরা ইউনিভার্সিটির টিচার, বড় চাকুরে, তারকা মানুষ, কিন্তু কোনদিন এমন হাসি দেখিনি। এমন সহজ, তৃপ্ত হাসিতে বলতে দেখিনি, ‘ভালো আছি, খুব’। কখনও না। বরং দেখা হতেই শুনেছি হতাশার প্রবল দীর্ঘশ্বাস, নেই নেই ধ্বনি! ‘আরও চাই, আরও চাই’ চিৎকার! তাহলে? সফলতা কী? ইউনিভার্সিটি পাস করতে না করতেই যেখানে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশি সবাই একাধারে কানের কাছে মন্ত্র জপতে শুরু করেন, ‘বিসিএস, বিসিএস, বিসিএস’।তারা একবারও জানতে চান না, আমি বিসিএস চাই কিনা! তারা শুধু জানেন, এই সমাজ, মানুষ, ব্যবস্থা, সফলতার যেই সংজ্ঞা ‘সেট’ করেছে তাতে সরকারি চাকুরে হওয়াই সফলতার সংজ্ঞা। নিরাপদ ঝুঁকিহীন জীবন! কিন্তু আমি কি নিরাপদ ঝুঁকিহীন ওই জীবন চাই? কুড়ি, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ বছর পরে ওই নিরাপদ জীবনের মানুষটি কোথায় থাকবেন? অমরত্ব পাবেন? আমি কোথায় থাকব? এই যে জীবনজুড়ে অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে বেড়িয়েছি, নিরাপদ ছাপোষা জীবন চাইনি, সেই আমিও কি অমরত্ব পাবো? পাবো না। তাহলে?তাহলে, জীবন তো পাবো? যতটুকু বেঁচে থাকা তার সবটুকু জুড়ে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে জীবনতো শুষে নিতে পারব। যা করতে চেয়েছি বুকের ভেতর থেকে, তা করতে তো পারব। সেই ‘করা’ জুড়ে জীবনের উল্লাস, সৃষ্টির আনন্দ, বেঁচে থাকার অমৃত আস্বাদ।তাতে অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করে ঈর্ষায়, হতাশায় ডুবে থাকা নেই। হাহাকার নেই। আছে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নিজেকে অতৃপ্ত না করে কেবলই নিজের স্বপ্নের, আনন্দের জীবনে আকণ্ঠ ডুবে থাকার সন্তুষ্টি।আসলে পরশ্রীকাতরতাহীনতার নামই সন্তুষ্টি, আর সন্তুষ্টির নামই সফলতা।লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা ও উপস্থাপক।এসইউ/এবিএস

Advertisement