শোলাকিয়া থেকে কল্যাণপুর। দু’জায়গাতেই পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করছে মানুষ। শোলাকিয়ায় জীবন দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে পুলিশ আর কল্যাণপুরে ৯ জঙ্গিকে খতম করে নিজেদের সক্ষমতা জানান দিয়েছে পুলিশ। জঙ্গিরা কখনো জানিয়ে আসে না। তারা সঙ্গোপনে এসে মানুষ খুন করে পালিয়ে যায়। কখনোবা দল বেঁধে এসে সন্ত্রাস করে। দেশে জঙ্গিরা খুনের মহোৎসব শুরু করেছে। রাজনৈতিকভাবে নানা কিছু বলা যাবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে, বাংলাদেশকে বিশ্ব দরকারে অনিরাপদ প্রমাণ করতে, এখানে আইএস’র ঘাঁটি গড়তে দিতে এসব খুন হচ্ছে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে।সবকথা বিশ্বাস করার পরও মানুষ চায় ব্যবস্থা নেয়া হোক। মানুষ এখন সেটাই দেখতে চায় যা তার নিরাপত্তার জন্য স্বস্তিদায়ক। একটা কথা মানতেই হবে যে সামগ্রিকভাবে জননিরাপত্তার অভাব তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছেড়ে দিবে কিনা দিনভর সেই হিসেব করছে। আর বিদেশিরা নিজেদের বন্দি করেছে খাঁচার ভেতর।মৌলবাদীরা সংগঠিত হয়ে ক্রমবর্ধমান হারে ও লক্ষণীয় শক্তি নিয়ে বিশেষ কিছু ব্যক্তির ওপর হামলা করছে। ব্লগার, লেখক, প্রকাশক থেকে শুরু করে রাজপথে পাহারারত পুলিশ, পুলিশের পরিবার, এমনকি সামরিক বাহিনীর সদস্য। আরও আছেন শিয়া সম্প্রদায় আর মাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও। এসব কিছুর মাঝে মোটেও সংশ্লিষ্ট নন, এমন বিদেশি নাগরিকও প্রাণ হারিয়েছেন একই ধরনের হামলায়।ঘটনাগুলো পৃথক পৃথক স্থানে ও লক্ষ্যে। তবে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী। এ অবস্থায় ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে নানাভাবে উঠে আসছে বাংলাদেশের খবর। সেই এক রাজিব হায়দার হত্যা, তারপর একের পর এক খুন। জানান দিয়ে জঙ্গি দমন হয় কিনা, তবে মানুষ আশ্বস্ত যে অভিযান চলছে। প্রতিটি বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের যেন অভাব না থাকে। যেন পুলিশ সদস্যরা আন্তরিকভাবে কাজটি করেন। জঙ্গি দমনে পুলিশের দক্ষতা, সক্ষমতা ও সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আছে সরকারের সংবেদনশীলতা নিয়েও। তারপরও মানুষের ভরসা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।সমস্যাটা শুধু আইনশৃঙ্খলা জনিত নয়, বরং অনেকাংশেই তা রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবে অনেকদিন কোন কর্মসূচি ছিল না। ছিল না সামাজিকভাবেও। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিরোধী কয়েকটি দল, কিছু না কিছু উগ্রবাদী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলছে। উগ্রবাদ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে আনার কোনো রাজনৈতিক প্রচেষ্টাও লক্ষণীয় নয়। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। আর ঠিক এ কারণেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পরিষ্কার কোন বার্তা কখনোই রাজনৈতিকভাবে দেয়া হয়নি যে এরাই রাষ্ট্রের এখন এক নম্বর শত্রু। এখন অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে সরকারের অবস্থান।কঠিন রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সাফল্য লাভের সম্ভাবনা নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্ভব হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকর করা গেছে, এর পেছনে সরকার, বিশেষ করে তার শীর্ষ পর্যায়ে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার কাজ করেছে বলেই। আবার সেখানেই কিছুটা শিথিলতার কারণেই বা কোন কোন মহল থেকে প্রশ্রয় থাকায় কোন কোন মহল পরিস্থিতি গোলা করে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠিগত ফায়দা তোলার চেষ্টায়রত। এমন প্রশ্রয়ের প্রকাশ্য মহড়ার নজির দেখা গেছে বারবার।সমস্যাটি রাজনৈতিক। এই রাজনীতি দেশীয় রাজনীতি যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিকও। দেশীয় রাজনীতি এ কারণে যে, এই টার্গেট কিলিং শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করতে গিয়ে। যারা আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ককে সামনে এনেছে তারাই হত্যা করছে, হত্যার সমর্থন দিচ্ছে, তারাই হেফাজতকে ঢাকায় এনেছিল, তারাই তাদের ডাকে সাড়া দিতে ঢাকাবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিল। এখানে রাজনীতি পরিষ্কার। আরেক রাজনীতি হলো বিশ্ব পরিমণ্ডলের। যুদ্ধবাজ দেশগুলো চায় বিশ্বব্যাপী তাদের মদদে সৃষ্ট আলকায়েদা, তালেবান ও আইএস’র প্রভাবকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক দেশ বাংলাদেশে নিয়ে আসতে।এমন বাস্তবতায় জঙ্গিবাদ নিয়ে সরকার তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্পষ্ট অবস্থান খুব জরুরি। কারণ তাদের অবস্থান অনেকটাই দোদুল্যমান। জঙ্গিদের পুলিশী চাপে রাখতেই হবে, তার কোন বিকল্প নেই। তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নিরসন সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়াতে হবে। এসব খুনিরা সংগঠিত আবার কোন কোন তরুণ জঙ্গি মতাদর্শে দিক্ষিত হয়ে ‘লিডারলেস’ জিহাদ শুরু হয়েছে। দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণের এখনই সময়। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট শুধু জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করছে। দীর্ঘ মেয়াদে এর সুফল হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু আশু করণীয় সব বাহিনীর কাজে সমন্বয়। বেশি প্রয়োজন শাসকদলের সব স্তরে কঠোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার।ইসলামি পাকিস্তানের বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ হল, সে যুদ্ধে পরাজয়ের ঠিক আগে পাক-বাহিনী ও তাদের তাঁবেদার ইসলামপন্থীরা এক মরণকামড় দিয়ে গেল। যে দেশটি স্বাধীন হতে যাচ্ছে, সে দেশটিতে সেক্যুলার মুক্তচিন্তার নেতৃত্ব যাঁরা দিতে পারবেন, সেই সব লেখক-কবি-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীকে তালিকা করে হত্যা করা হল। আজ বাংলাদেশ আবার সেই যুগ সন্ধিক্ষণে। আজ নতুন করে শুরু হয়েছে হত্যা। কিন্তু বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে জানে। অতীতেও অনেকবার ধ্বংসের-কিনারা থেকে জনগণই বাংলাদেশকে ফিরিয়ে এনেছে। এবং আবরো সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সন্ত্রাসী শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে বলে নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে জাতি, যেমনটা হয়েছিল ১৯৭১ এ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি তার মর্যাদা দেবে?এইচআর/আরআইপি
Advertisement