দেশজুড়ে

সুস্থ হয়েও ওদের ঠিকানা ‘পাবনা মানসিক হাসপাতাল’

`খুব ইচ্ছে করে বাসায় যেতে। কিন্ত কেউ নিতে আসে না।` ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ‘পাবনা মানসিক হাসপাতাল’ এর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মানসিক রোগী সাইদ হোসেন সুস্থ হয়েও বাড়ি যেতে না পারার বেদনা এভাবেই ব্যক্ত করেন জাগো নিউজের কাছে। সাইদের মতো আরো অনেক রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েও বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন না। এদের কারো ঠিকানা ভুল, আবার কোনো অভিভাবক বা পরিবার তাদের নিতেও রাজি নয় বলে ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন। কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, এ সংখ্যা এখন ২১ জন। এসব রোগীদের নিয়ে কর্তৃপক্ষ পড়েছেন মহাবিপাকে। এদের চিকিৎসা খরচ মেটানো এবং শয্যা খালি না করার কারণে ওই শয্যায় নতুন রোগীও ভর্তি করা যাচ্ছে না। তবে শত অসুবিধা হলেও দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে থাকার কারণে এরা এখানকার চিকিৎসক, নার্সসহ সবার আপনজন হয়ে উঠেছেন। হাসপাতালের রেজিস্ট্রারের মতে, ৩০ বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত এরা আছেন এখানে।৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাইদ হোসেন পাবনা মানসিক হাসাপাতালে ভর্তি হন ১৯৯৬ সালে। ৩৬ বছর বয়সে ভর্তি হয়েছিলেন। এখন বয়স ৫৫ বছর। তার বাবার নাম আবুল হাশেম মিয়া। তাকে ঢাকার মগবাজার নয়াটোলার ২৫৪/এ হেলেনাবাদ ঠিাকানা দিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল। পুরুষ পেয়িং বেডে থাকা অবস্থায় সরকারি পাওনা পরিশোধ না হওয়া ও যাতায়াতের ভাড়া জমা না থাকায় ১৯৯৭ সালে বিনা ভাড়ার বেডে স্থানান্তর করা হয়। সাইদ জানান, চার ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় সে। বাবা ছাপাখানায় মেশিন চালাতো। বিয়ের পরই অসুস্থ হয়ে পড়ায় সদ্য বিয়ে করা বউ তালাক দিয়ে চলে যান অন্যত্র। এখন তার ঠিকানা ৫ নম্বর ওয়ার্ডের অন্যান্য রোগীদের সঙ্গেই। চিকিৎসকরা জানান, অন্যান্য রোগীদের মধ্যে থাকার কারণে এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে সাইদ হোসেন মানসিকভাবে আবারো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।     ২০১০ সালে পেয়িং বেডে ভর্তি করা হয় বদিউল আলমকে। ২০০৫ সালে ৩ বছর বয়সে তাকে ভর্তি করা হয়। এখন বয়স ১১ বছর। পুরুষ পেয়িং বেডে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে যায় বদি। এরপর তার যাতায়াত ভাড়া বাবদ জমাকৃত টাকা দিয়ে ২ মাস পর বাড়ির ঠিকানায় পাঠানো হলে ঠিকানা ভুল হওয়ায় আবার তাকে হাসপাতালে ফিরিয়ে আনা হয় এবং বিনা ভাড়ার বেডে ভর্তি করা হয়। এখন তাকে রাখা হয়েছে ১ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের ব্রাদার আসাদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, বদি বেশ কিছুদিন সুস্থ ছিলেন, কথা বার্তা বলতেন। এখন কোনো কথা বলে না।প্রাপ্ত তথ্য মতে, বদিকে যে ঠিকানা দিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল তা হলো- পিতা মৃত আব্দুল ওয়াদুদ শিকদার, প্রযত্নে জিয়াউল আলম, ২৪৩ মধ্য বাসাবো, সবুজবাগ, ঢাকা। ১৯৯৪ সালে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হন কাজী আকরামুল জামান। ওই সময় তার বয়স ছিল ২৫ বছর। এখানে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়ে গেলে ভর্তির সময় যাতায়াত ভাড়া বাবদ জমাকৃত টাকা দিয়ে ২০০৩ সালে ১২ জানুয়ারি তাকে বাসার ঠিকানায় (ভর্তির সময় দেয়া ঠিকানা) ফেরত পাঠানো হয়। কিন্ত অভিভাবকের দেয়া ঠিকানা ভুল থাকায় তাকে ফেরত নিয়ে এসে আবার হাসপতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে সে এখানেই আছে। ভর্তির সময় আকরামুলের ঠিকানা দেয়া হয়েছিল পিতা-কাজী গোলাম গাউস, বাসা -১১৩, রোড-৪, মিরপুর-১২/এ, পল্লবী, ঢাকা। কাজী আকরামুল জামান জানান, তার বাবা সমবায় বিভাগে চাকরি করতেন। ছয় ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। মিরপুর বাংলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্ত এরপর পরই অসুস্থ হয়ে গেলে বিয়ে আর করা হয়নি। এখন তার ঠিকানা পাবনা মানসিক হাসপাতাল। তার আপসোস কেউ তাকে আর নিতে আসে না।পাবনা মানসিক হাসপাতালের পেয়িং বেডের ঠিকানাবিহীন আরেক রোগী আশরাফ উদ্দিন খান ওরফে বিদ্যুৎ। বয়স ৩৭ বছর। ৭ বছর আগে অর্থ্যাৎ ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই তাকে এখানে ভর্তি করা হয়। নারায়ণগঞ্জ ৮০ নং এসিধর রোড ঠিকানায় তাকে ভর্তি করা হয়। সুস্থ হলে ২ আগস্ট ১৫ তারিখে হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় শহিদুলকে দিয়ে তাকে প্রদত্ত ঠিকানায় ফেরত পাঠানো হলে বাড়ির লোকজন তাকে গ্রহণ করেনি। এমনকি সারাদিন বাড়ির সামনে রোগী নিয়ে বসে থাকলেও কেউ দরজা খুলেনি। ওয়ার্ডবয় শহিদুল জানান, থানা থেকে পুলিশ নিয়ে এসেও তাদের কাছে রোগীকে ফেরত দেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর ৫ আগস্ট ১৫ তারিখে তাকে আবারো এখানে ভর্তি করা হয় এবং তখন থেকে এখানেই তার ঠিকানা।বিদ্যুৎ জানান, তার বাবার নাম আলহাজ্ব রেহাজ উদ্দিন। এদের মতো পাবনা মানসিক হাসপাতালে যারা সুস্থ হয়েও পরিবার ফেরত না নেয়া অথবা ভুল ঠিকানার কারণে দিনের পর দিন রয়ে গেছেন তারা হলেন- ইতেমাতুদ্দৌলা (৪৪, ২০১৪ সাল থেকে আছেন), শাহজাহান আলম (৪৩, ২০০৪ সাল থেকে), মহিউদ্দিন (২০০২ সাল থেকে), মোখলেছুর রহমান (৫৩, ২০০৩ সাল থেকে) ডলি (৩৮, ২০১১ সাল থেকে), জাকিয়া সুলতানা (২৭, ২০০৯ সাল থেকে), সিপ্রা রানী (৪৯, ১৯৯৯ সাল থেকে) রয়েছেন। এছাড়া, সাহানারা আকতার (৪৮, ১৯৯৯ সাল থেকে), আরজু বেগম (৪২, ২০০৪ সাল থেকে), নাজমা আক্তার (৩৩, ২০১১ সাল থেকে), কাজী খোদেজা (৫৫, ২০০৫ সাল থেকে), নাজমা নিলুফার (৫৫, ১৯৮৯ সাল থেকে ভর্তি। ফেরত না নেয়ায় আবার অসুস্থ), নাইমা চৌধুরী (৩১, ২০০৯ সাল থেকে), আমেনা খাতুন বুবি (৫০, ১৯৮৪ সাল থেকে আছে। ঠিকানাহীন এবং এখন অসুস্থ), গোলজার বিবি (৪৮, ২০০০ সাল থেকে), অনামিকা বুবি (৪১, ১৯৯৯ সাল থেকে। ঠিকানাহীন, এখন অসুস্থ), সাহিদা ( ৫০, ১৯৯৫ সাল থেকে) রয়েছেন। তাছাড়া মাহবুব আনোয়ার নামে এক রোগী ২০ বছর ধরে এখানে থেকে ২০১৫ সালে ৫৩ বছর বয়সে এখানেই মারা যান। ভুল ঠিকানার কারণে তাকেও বাড়িতে পাঠানো সম্ভব হয়নি। ছকিনা নামে আরেক রোগীও ১২ বছর হাসাপাতালে থেকে গত বছর ৪৭ বছর বয়সে মারা যান।  পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, হাসাপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় শয্যা সংখ্যা কম। তারপর সুস্থ হওয়ার পরও বা ঠিাকানা ভুল হওয়ার কারণে যাদের বাড়িতে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না তাদের নিয়ে আমরা খুবই বিপাকে। এদের জায়গায় নতুন রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পাবনা মানসিক হাসপাতালের সেবার মান দৃষ্টান্তমূলক।এখান থেকে প্রতি বছর গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানসিক রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।এসএস/আরআইপি

Advertisement