বিশেষ প্রতিবেদন

বহুজাতিক কোম্পানির কর ফাঁকি ঠেকাতে শুরু হচ্ছে অডিট

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কর ফাঁকি ঠেকাতে তিন বছর আগে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠন করলেও প্রয়োজনীয় জনবল এবং যন্ত্রপাতির অভাবে এখনও মূল কাজই শুরু করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কোম্পানিগুলোর লেনদেনের প্রতিবেদন ইতোমধ্যে সংগ্রহ করেছে সংস্থটি। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকেই সেলটি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লেনদেনের প্রতিবেদনের অডিট পুরোদমে শুরু করবে। সূত্র জানায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় ট্রান্সফার প্রাইসিং বা মূল্য লুকোচুরি করে অর্থপাচার ঠেকানো কৌশল নির্ধারণে সেল গঠন করতে আয়কর অধ্যাদেশে বেশ কয়েকটি ধারা সংযোজন করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ আয়কর অধ্যাদেশে সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সংস্থাটির এ সেল এখনো পুরোপুরি কাজ শুরু করতে পারেনি।এ বিষয়ে গত মাসে জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তৃতায় এনবিআরের এই উদ্যোগের অগ্রগতির বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, এনবিআর ইতোমধ্যেই আন্তদেশীয় কর ফাঁকি রোধে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠন করেছে। তবে এই পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।প্রসঙ্গত, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কর ফাঁকি দিয়ে নিজেদের এক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ অন্য দেশে অবস্থিত সহযোগী প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যায়। সাধারণত যে সব দেশে কর হার বেশি সে সব দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে নানা কৌশলে অর্থের কর হার কম এমন দেশের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে নেওয়া হয়। এতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়ে, কিন্তু কর কম দিতে হয়। এটা একধরনের অর্থপাচার। এতে প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় কর হার বেশি এমন দেশগুলো। এভাবে বিশ্বজুড়েই অনেক বহুজাতিক কোম্পানি কর এড়িয়ে যায় বা কর ফাঁকি দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কাজে কোম্পানিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন কৌশল নেয়।বাংলাদেশে কাজ করছে এমন অনেক বহুজাতিক কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে একই প্রক্রিয়ায় কর ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কর তুলনামূলক বেশি।এ বিষয়ে এনবিআরের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, গত তিন বছর ছিল এনবিআরের প্রস্তুতিমূলক পর্ব। এ সময়ে এনবিআরের কর্মকর্তারা কীভাবে কাজ করবেন, তার পাশাপশি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছেন। কয়েকজন কর্মকর্তাকে দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও মরক্কোতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ জাগো নিউজকে বলেন, ট্রান্সফার প্রাইসিং ব্যবস্থা সফল করা খুবই কঠিন হবে। কেননা, এনবিআরের সেই দক্ষ জনবল নেই। তার মতে, পণ্যের দামের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অর্থ বিদেশে পাচারের বিষয়টি এনবিআরের একার পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিস্তৃত সহায়তা ও সমন্বয় দরকার। কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে থাকে।অন্যদিকে, ২০১৫ সালের জুন মাসে এনবিআরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিভিন্ন দেশে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যমে মুনাফা স্থানান্তরের নামে কর ফাঁকি ও অর্থপাচার করে। এটা রোধ করতেই ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠন করা হয়েছে। ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের কার্যক্রমের ফলে রাজস্ব আয় বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। এছাড়া গত বছর সেপ্টেম্বরে সেল থেকে মাঠপর্যায়ের রাজস্ব কর্মকর্তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লেনদেনের প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে সেলের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা এখনও দেখা যায়নি।এনবিআরের তথ্য মতে, দেশে ১৭৫টি বহুজাতিক কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানি কর ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারপরও কোম্পানিগুলোর কর ফাঁকি রোধে তেমন কিছুই করতে পারছে না সংস্থাটি।তবে এ বিষয়ে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লেনদেনের প্রতিবেদন ইতোমধ্যে সংগ্রহ করেছেন ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের অফিসাররা। সবকিছুই চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। গত জুন মাসে সেলের কর্মকাণ্ডের জন্য কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসেই সংগৃহীত প্রতিবেদনের মধ্য থেকে পরীক্ষামূলকভাবে অডিট শুরু হবে। তবে আগামী জানুয়ারি থেকে পুরোদমে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল কাজ শুরু করবে।এবিআর সূত্রে জানা গেছে, কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক লেনদেন যদি বছরে তিন কোটি টাকার বেশি হয়, তবে সে প্রতিষ্ঠানকে নজরদারি করবে এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল। তিন কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলে ওই প্রতিষ্ঠানকে সংশ্লিষ্ট তথ্য, দলিলাদি সংরক্ষণ করতে হবে। এমনকি বিদেশের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ধরনসহ যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। ওই প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত দাম দিয়েই পণ্য আমদানি করেছে কি না, তা বছর শেষে যাচাই-বাছাই করবে এনবিআর। প্রতিষ্ঠানটি যে পণ্য আমদানি করেছে সেই পণ্যের বাজারমূল্য নির্ধারণ করবেন কর কর্মকর্তারা। সেটাকে ধরেই পণ্যের শুল্কায়ন করা হবে।উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে, কোনো একটি কোম্পানি বিদেশ থেকে অন্য একটি কোম্পানির কাছ থেকে ২০০ টাকা দরে পণ্য আমদানি করল। সেই পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে একই ধরনের পণ্য অন্য প্রতিষ্ঠান কত টাকা দর দিয়ে আমদানি করে কিংবা একই ধরনের পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কত, সেটাই বাজারমূল্য।ধরা যাক, কোনো প্রতিষ্ঠান বাজারমূল্যের চেয়ে ১০০ টাকা বেশি দামে পণ্য আমদানি করল। সেটা ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল কর্মকর্তারা ধরে ফেললেন। তাহলে ওই ১০০ টাকার ওপর বাড়তি করারোপ করবেন কর কর্মকর্তারা। এ ছাড়া জরিমানার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে কর কর্মকর্তাদের।পণ্য রফতানির নামে বিদেশে টাকা পাচার হলে সেটা ধরতেও কাজ করবে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল। সে ক্ষেত্রেও বাজারমূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করবে তারা।এমইউএইচ/একে/এমএস

Advertisement