খেলাধুলা

উপমহাদেশের হকি, এখন শুধুই স্মৃতি

‘অলিম্পিক’- ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ।’ শুধু বিশ্বের সেরা ও সর্ববৃহৎ ক্রীড়া আসরই নয়, মর্ত্যরেও শ্রেষ্ঠ কোন অনুষ্ঠান। চার বছর পর পর অলিম্পিক এসে নাড়িয়ে দিয়ে যায় বিশ্বকে। হোক তা আকারে বড়, তারপরও ক্রীড়ানুষ্ঠান। তা নিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড়, হৈ চৈ আলোড়ন- অবাক করার মত ব্যাপার বৈকি।কিন্তু আসল সত্য, সেই ক্রীড়া আসর হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক উৎসব উপলক্ষ। সারা বিশ্বকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলে অলিম্পিক। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় সর্বত্র। উৎসাহ-আগ্রহ ও উদ্দীপনার মানদণ্ড ধরলে দক্ষিণ এশিয়া ও এ উপমহাদেশে হৈ চৈ তুলনামুলক বেশি। এমনিতেই  ক্রীড়ানুরাগি ও খেলা পাগল হিসেবে এ অঞ্চলের আছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি।তাই দক্ষিণ এশিয়ায় অলিম্পিক নিয়ে সাড়া একটু বেশিই পড়ে। উপমহাদেশের কোটি কোটি খেলা পাগল মানুষ নড়েচড়ে বসেন। সাময়িকভাবে হলেও অলিম্পিক ওই ক’টা দিন হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের মানুষের প্রতিদিনকার জীবনের অংশ। বসার-শোবার ঘর ছাপিয়ে রান্না ঘরেও অলিম্পিক ফুটবল, হকি, ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড, টেনিস, সাঁতার, শ্যূটিং, জিমন্যাস্টিক্স ও ব্যাডমিন্টন নিয়ে  চলে নানা কথা বার্তা। আলোচনা-পর্যালোচনা।কথায় বলে না, প্রদিপের নীচেই থাকে অন্ধকার। এ অঞ্চল তথা উপমহাদেশের অবস্থা ঠিক তাই। লোক সংখ্যাকে প্রধান মানদন্ড ধরলে এ উপমহাদেশ বিশ্বের অনেক অঞ্চলের চেয়ে বড়। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান মিলে লোকসংখ্যা পৌনে দু‘শো কোটির মত। উৎসাহ-আগ্রহও সর্বোচ্চ।অলিম্পিক এলে রাত জাগায় সব অঞ্চলকে ছাড়িয়ে টিভির সামনে উন্মুখ হয়ে বসে থাকায় এ উপমহাদেশের খেলা প্রেমীদের জুড়ি নেই। ক্রীড়াপ্রেমী, দর্শক, অনুরাগি, ভক্ত ও সমঝদার হিসেবে ফ্রন্টলাইনার; কিন্তু  তা হলেও এ উপমহাদেশের ক্রীড়াবিদরা অনেক পিছনে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাফল্য নাই বললেই চলে।দীর্ঘ ৮০ বছর সাফল্য সোনার হরিণ হয়েই ছিল। এ সময়ে দলগত খেলা হকিতে ১১বার স্বর্ণ ধরা দিলেও কোন ব্যক্তিগত ইভেন্ট থেকে একটি স্বর্ণ বিজয়ের কৃতিত্বও ছিল না। ২০০৮ সালে বেইজিংয়ে ভারতীয় শ্যূটার অভিনব বিন্দ্রা সে দীর্ঘ দিনের অপ্রাপ্তি ঘুচিয়েছেন। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে স্বর্ণ জিতে শুধু এ অঞ্চলের শ্যূটারদের মুখই উজ্জ্বল করেননি।  উপমহাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে অলিম্পিকে ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণ বিজয়ের দূর্লভ কৃতিত্বের অধিকারি নিজের নামকে স্বর্ণ খচিত করে রেখেছেন এ ভারতীয় রাইফেল শ্যূটার।তার আগে অলিম্পিকে এ উপমহাদেশের আশা ভরসাই ছিল ‘হকি’। দীর্ঘদিন অলিম্পিক গেমসে উপমহাদেশের ‘হারাধনের একটি ছেলে’ হয়ে ছিল প্রাচীন এই খেলাটি। গোটা বিশ্ব যখন ফুটবল, এ্যাথলেটিক্স, জিমন্যস্টিক্স, সাঁতার, টেনিস, বক্সিং, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস নিয়ে মেতে থাকতো, এ উপমহাদেশের শত কোটি মানুষের চোখ তখন হকির ওপর স্থির হয়ে থাকতো।না থেকে উপায়ও ছিল না। ওই একটি ইভেন্টেই যে সোনালি সাফল্যের  দেখা মিলতো!  উপমহাদেশের দুই দল ভারত ও পাকিস্তান ১১বার অলিম্পক হকির স্বর্ণ বিজয়ী। ভারত ৮ বার- ১৯২৮, ১৯৩২, ১৯৩৬, ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৬, ১৯৬৪ ও ১৯৮০ সালে। আর পাকিস্তান ১৯৬০, ১৯৬৮ ও ১৯৮৪ এই তিনবার স্বর্ণ জিতেছে। ১৯২৮ থেকে ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলস- এই ১৪বারের অলিম্পিকের ১১ বারই হকির স্বর্ণ এসেছে উপমহাদেশে। এর মধ্যে ১৯২৮, ১৯৩২ ও ১৯৩৬- এই তিনবার দেশ বিভাগের আগে ‘বৃটিশ ভারত’ নামে অলিম্পিকে অংশ নিয়ে হকিতে স্বর্ণ জিতেছে ভারতীয়রা।১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পরও ভারতের প্রাধান্য ছিল। স্বাধীন ভারত ১৯৪৮, ১৯৫২ ও ১৯৫৬- পর পর তিনবার স্বর্ণ জিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেয়। ভারতের একচেটিয়া প্রাধান্য খর্ব হতে থাকে ১৯৬০ থেকে। সেবারই ভারতের বদলে উপমহাদেশের দ্বিতীয় দল হিসেবে প্রথম ফিল্ড হকির স্বর্ণের দেখা পায় পাকিস্তান। এরপর ৬৮ ও ৮৪‘ তেও অলিম্পিক হকিতে সেরা হয় পাকিস্তানিরা।১৯২৮ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত যতবার অলিম্পিক হকি হয়েছে, একবার ছাড়া প্রতিবার উপমহাদেশের অন্তত একটি দল ফাইনাল পর্যন্ত উঠেছে। এর মধ্যে ১৯৫৬, ১৯৬০ ও ১৯৬৪- পর পর তিন আসরে হকির ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই চির প্রতিদ্ব›দ্বী ভারত এবং পাকিস্তান। যার দুবার শেষ হাসি হাসে ভারতীয়রা। একবার পাকিস্তান।১৯৭৬ সালে মন্ট্রিল অলিম্পিকেই প্রথম ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘ দিনের একচেটিয়া প্রাধান্য খর্ব হয়। ওই দুই দলের কেউ সেবার ফাইনালেই উঠতে পারেনি। সেবার ফাইনাল খেলে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। কিউইদের গলায় শোভা পায় সোনার পদক। আর ডাচদের হারিয়ে পাকিস্তান পায় ব্রোঞ্জ। তার চার বছর পর জাফর ইকবাল ও মোহাম্মদ সাহেদের হাত ধরে তিন আসর (৬৮, ৭২ ও ৭৬) পর আবার হারানো শিরোপা পুনরূদ্ধার করে ভারত। মস্কোয় বসা সেবারের আসরের ফাইনালে স্প্যানিশদের হারিয়ে ভারত জিতে স্বর্ণ। সেটাই ভারতের শেষ অলিম্পিক বিজয়।চার বছর পর লস অ্যাঞ্জেলেসে পশ্চিম জার্মানীকে হারিয়ে পাকিস্তানও ঠিক তিন বারের না পাবার ব্যর্থতা (৭২, ৭৬ ও ৮০) ঝেড়ে আবার স্বর্ণ জেতে। বলে রাখা ভাল ৮০‘র মস্কো অলিম্পিকে আমেরিকাপন্থী দেশগুলো অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। পাকিস্তানও সেবার যায়নি অলিম্পিকে অংশ নিতে। একইভাবে ৮৪ ‘তে লস এ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকেও রাশিয়া পন্থীরা বয়কট করে। যে কারনে সেবার আবার অনুপস্থিত ছিল ভারত; কিন্তু ১৯৮৮ সালে সিউল অলিম্পিক থেকেই ভারত-পাকিস্তান উপখ্যানের ইতি।হকিতে সিনথেটিক টার্ফের প্রচলনের পর থেকেই ধীরে ধীরে উপমহাদেশীয় হকির স্টিকওয়ার্ক আর টিম ওয়ার্ক থেকে ফিল্ড গোল আদায়ের চিরায়ত ধারার অবসান। কৃত্রিম টার্ফে ঘাষের মাঠের চেয়ে শক্তি লাগে অনেক বেশি। শারীরিক সক্ষমতা দরকার প্রায় দ্বিগুণ। ধ্যানচাঁদ, জাফর ইকবাল, মোহাম্মদ সাহেদ, ধনরাজ পিল্লাই, ইসলাহউদ্দীন, কালিমউল্লাহ, হানিফ খান, হাসান সর্দার ও শাহবাজরা আর স্টিকের জাদুকরি কারুকাজ ও ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানায় ইউরোপীয় দলগুলোকে পর্যদুস্ত করতে পারতেন।অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, জার্মানী, গ্রেট ব্রিটেন ও স্পেন ওই সব মেধাবি খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত নৈপুন্যের কাছে হার মেনেছে বহুবার; কিন্তু সিনথেটিক টার্ফে সেই স্টিকের কাজ ও ব্যক্তিগত নৈপুন্য দেখানোর সুযোগ কম। তার চেয়ে টেকনিক ও ট্যাকটিস হয়ে গেছে বড়। সবচেয়ে বড় কথা, পেনাল্টি কর্নারই ব্যবধান গড়ে দিচ্ছে সব।আর এই জায়গায় দিনকে দিন ভারত ও পাকিস্তানের ব্যক্তিগত নৈপুন্যের হকি মার খেয়ে গেছে। তারপরও পাকিস্তান ’৯২ ও ২০০০ সালে দুবার সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠেছে; কিন্তু ফাইনালে পৌঁছাতে পারেনি। ভারত ততদুরও যেতে পারেনি। মোদ্দা কথা, এক সময় যে হকি ছিল উপমহাদেশের গৌরব ও সাফল্যে গাঁথা, সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু- সময়ের প্রবাহে সে সম্ভাবনার প্রদীপ নিভে গেছে। অন্য দলগত খেলাগুলোতে এ অঞ্চলের অবস্থা আরও খারাপ। কাজেই এখন ব্যক্তিগত সাফল্যই ভরসা।মাঝে দুই আসর আগে ২০০৮-এ বেইজিংয়ে ভারতের অভিনব বিন্দ্রা শ্যূটিংয়ে স্বর্ণ উপহার দিলেও এ অঞ্চলের আর কোন ক্রীড়াবিদ অতবড় সাফল্যর নাগাল পাননি।সাফল্য ধরা না দেয়ায় আর সাফল্যের তেমন কোন হাতছানি না থাকায় এ অঞ্চলের খেলাপ্রেমীরাও অন্যদিকে ধাবিত হয়েছেন। তাই ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা, নেপাল- মালদ্বীপের বর্তমান প্রজন্ম উসাইন বোল্ট আর নেইমারকে নিয়েই মেতে আছে সবচেয়ে বেশি।অলিম্পিক নিয়ে জাগো চ্যাম্পিয়নের বিশেষ এই আয়োজন পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে…আইএইচএস/বিএ

Advertisement