১৮৯৬ সালে যাত্রা শুরু আধুনিক অলিম্পিকের। লাল-সবুজের বাঙ্গালির সেই ক্রীড়া মহাযজ্ঞে নাম লেখানো ১৯৮৪’তে। লাতিন আমেরিকার প্রথম অলিম্পিক আসর, ‘রিও-গেমসে’ বাংলাদেশের অংশগ্রহন টানা নবমবার। ৭ ক্রীড়াবিদ আর ৯ কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের এবারের কন্টিনজেন্টই অলিম্পিকের ইতিহাসে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ। তবে পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল দেশের জন্য অলিম্পিক পদক এখনো দুর আকশের চাঁদ। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা যায়, ভালোবাসা যায়, স্বপ্ন দেখা যায়। তবে ধরা-ছোঁয়া যায় না। শুরুতে অলিম্পিকে বাংলাদেশের অ্যাথেলেটদের পরিচয় ছিলো পর্যবেক্ষক। ইদানিং বদলে গেছে সেই পরিচয় ক্রীড়াবিদ ট্যাগে। তাও যোগ্যতায় নয়। অলিম্পিক ইভেন্টে যোগ্যতা পরিমাপক সূচক কিংবা টাইমিং’এ এখনো যোজন যোজন দুরে মেজবাহ, বাকি, মাহফিজুর’রা। সাত-আটের দশকে অনটনের সাথে নিয়ত যুদ্ধ করা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে আমেরিকানদের দেয়া খাদ্য সাহায্য ‘পি-এল ৪৮০’ কিংবা হাল আমলের আমেরিকান ডিভি ভিসার মতো অলিম্পিকের প্রবর্তক আইওসি লটারিতে বরাদ্দ করে অনগ্রসর তৃতীয় বিশ্বের ক্রীড়াবিদের জন্য ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি। সেই মোক্ষম ধরেই বাঙালির অলিম্পিক দর্শন। অলিম্পিকের আসরে বাংলাদেশ থেকে যারাই অংশ নেন, বাস্তবিক অর্থে গেমসের অধিকাংশ সময় তাদের একটাই পরিচয়, পর্যটক। বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নেয়া ক্রীড়াবিদ, কর্মকর্তা, পর্যবেক্ষক কিংবা সাংবাদিক সবাই দুই সপ্তাহের গেমসের অধিকাংশ সময়ই নির্ভার হয়ে ঘুরে বেড়ান ভেন্যু থেকে ভেন্যু’তে। ২০১২’র লন্ডন অলিম্পিক কভার করার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি চার বছর আগের অলিম্পিক আসরে আমার কাছে বাংলাদেশ অধ্যায় মানেই মাহফিজুর রহমান সাগরের আধা মিনিটের সাঁতার, জিমন্যাস্ট সাইক সিজারের মিনিট দশেকের ঝলক কিংবা প্রমীলা শ্যুটার শারমিন আক্তার রত্নার ২৭তম স্থান নিয়ে হিট থেকে বিদায়। এর আগে বা পরে কিছু নেই। আমরা বাংলাদেশের সাংবাদিকরা গেমস কভার করছি চাপমুক্ত হয়ে। দেশে অফিসের বিশেষ কোন চাওয়া নেই। বাংলাদেশের পদক জয়ের নেই কোন সম্ভাবনা। আমাদের টেনশন নেই, ক্রীড়াবিদ কর্মকর্তারাও নির্ভার। কমবেশি সবাই পর্যটকের ভূমিকায়। ল্যাপটপ, ভিডিও ক্যামেরা, ইন্টারনেট, বুম, ট্রাইপড নিয়ে মাইলের পর মাইল ঘুরছি, পিটিসি দিয়ে দিনে দুটো রিপোর্টও পাঠিয়েছি। তারপরও কি যেন নেই। বারবার নিজেকেই প্রশ্ন করছি, এই বিশাল যজ্ঞে কেন আমি? কেন আমার বাংলাদেশ? আয়োজকদের আমন্ত্রণ আছে, সেই আমন্ত্রণে হয়তো আন্তরিকতাও আছে; কিন্তু আমন্ত্রিতের আমন্ত্রণ রক্ষার দায় নেই! টিভি সাংবাদিকের ভিডিও ক্যামেরা, ল্যাপটপ, রিপোর্ট নিয়ে যতটা ব্যস্ততা তার চেয়ে হাজারগুণ ব্যস্ততা পর্যটকের (তখনো সেলফি এতটা সর্বগ্রাসী জনপ্রিয় হয়নি) ডিজিটাল ক্যামেরার। ছোট-বড়, অখ্যাত-বিখ্যাত, সেলিব্রিটি, ইন্টারন্যাশনাল স্টার, লিজেন্ড যাকেই দেখছি হ্যাংলার মতো তার পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার বোতামে আঙ্গুল চালিয়েছি। গেমস কিংবা অলিম্পিক পদক বাংলাদেশের কাছে কতটা দুর আকাশের চাঁদ তা পরিসংখ্যানেই পরিস্কার। ২০১২’র অলিম্পিকসে ছেলেদের ১০০ মিটার দৌড়ে জ্যামাইকার উসাইন বোল্ট নয় দশমিক ছয়-তিন সেকেন্ডে স্বর্ণ জেতেন, স্বর্ণ জয়ী জ্যামাইকার মেয়ে শ্যালি অ্যান ফ্রেজারের টাইমিং দশ দশমিক সাত-পাঁচ সেকেন্ড। বাংলাদেশের ছেলে মোহন খান হিটে বাদ পড়েন ১১ দশমিক দুই-পাঁচ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে। এবার রিও গেমসে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া বাংলাদেশের দ্রুততম মানব মেজবাহ’র একশো মিটারের সেরা টাইমিং এগারো দশমিক সাত-পাঁচ সেকেন্ড, দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তারের বারো দশমিক দুই শূন্য। ২০১২’র লন্ডন অলিম্পিকের ছেলেদের ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে ফ্রান্সের ফ্লোরেন্স মনদু’র স্বর্ণ জয় ২১ দশমিক তিন-চার সেকেন্ডে। হিটে বাদ পড়া বাংলাদেশের মাহফিজুর রহমান সাগরের টাইমিং ২৪ দশমিক ছয়-চার সেকেন্ড। অলিম্পিক পদক জেতা না হলেও, একটি বিষয়ে সবার আগে আমার জন্মভ‚মি। সাতশো কোটি জনসংখ্যার ২০৪টি দেশের প্রায় এই পৃথিবীতে ৪০৫ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশগুলো এখোনো অলিম্পিক পদক জিততে পারেনি। এই অক্ষম দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনসংখ্যায় তালিকার এক নম্বরে ১৬ কোটি’র বাংলাদেশ। দুই’আড়াই কোটি জনসংখ্যার মালাউয়ি, বুরকিনা ফাসো কিংবা কঙ্গো হিট উতরে কখোনো-সখোনো পদক জেতার সম্ভাবনাও জাগিয়েছে; কিন্তু হিটেই দম শেষ বাংলাদেশের! অলিম্পিকের ব্যর্থতা নিয়ে বাংলাদেশকে প্রকৃতই সমালোচনা করার অধিকার আমরা রাখি কি না, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। সর্বোচ্চ স্তরের ক্রীড়া আসর অলিম্পিকে সাফল্য পায় একমাত্র ক্রীড়ামনস্ক দেশগুলো। যেখানে একজন ক্রীড়াবিদ বা ক্রীড়াদলকে প্রারম্ভিক পর্যায় থেকে পরিকল্পনামাফিক সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়া হয়। বাংলাদেশে একমাত্র ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো খেলার গুরুত্ব নেই, পৃষ্ঠপোষকতা নেই, জনপ্রিয়তাও নেই। অ্যাথেলেটিক্স, সাঁতারের মতো অলিম্পিক ইভেন্টে’র চর্চা পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশে নেই বললেই চলে। মিডিয়াও এই খেলাগুলোর চর্চা বা পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে মাথা ঘামাতে অনাগ্রহী। বিকেএসপি’র মতো প্রতিষ্ঠানের পেছনে সরকার গত ২৫ বছর ধরে খরচ করেছে কয়েকশো কোটি টাকা। বিনিময়ে ন্যুনতম এশীয়মানের একজন অ্যাথেলেটও জাতিকে উপহার দিতে পারেনি এই শ্বেতহস্তি! এরপরও অলিম্পিক আসর ভাঙ্গিয়ে দেয় ঘুমকাতুরে বাঙালি’র চার বছরের কুম্ভকর্ণের ঘুম। ক্রীড়া তীর্থের দর্শন পেতে ক্রীড়াবিদ, কর্মকর্তা, সাংবাদিকদের আগ্রহের কমতি নেই। বায়োডাটা সমৃদ্ধ করতে আমার মতো ক্রীড়া সাংবাদিকরা উঁকিঝুঁকি দেয় অলিম্পিকের আঙ্গিনায়। ২০১২’র আসরের পর পেরিয়ে গেছে চারটি বছর। স্মৃতির অলিন্দে এখানো হানা দেয় জ্যামাইকান গ্রেট উসাইন লাইটনিং বোল্টের অলিম্পিক পার্কের ট্র্যাকে বিদ্যূৎ ঝলকের দৌড়, অ্যাকুয়েটিক সেন্টারের জলরাশিতে মার্কিন সাঁতারু মাইকেল ফেলপসের স্বর্ণ-অভিযান, ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ফুটবল ফাইনালে মেক্সিকোর কাছে ফাইনালে হেরে স্বর্ণ জয়ের স্বপ্ন বিসর্জনে নেইমার-মার্সেলোর সঙ্গে সুন্দরী সাম্বা কিশোরির অশ্রুসজল চোখ কিংবা উইম্বলডন সেন্টার কোর্টে উইমেন্স সিঙ্গলসের ফাইনালে সেরেনা উইলিয়মসের কাছে নাস্তানাবুদ হওয়া প্রিয় তারকা রুশ সুন্দরী মারিয়া শারাপোভার শত ভক্তের মারিয়া....মারিয়া কণ্ঠে আহাজারি ।অলিম্পিক নিয়ে জাগো চ্যাম্পিয়নের বিশেষ এই আয়োজন পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে… আইএইচএস/পিআর
Advertisement