বিশেষ প্রতিবেদন

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের ওষুধ

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ। এই ওষুধ এখন এশিয়া, আফ্রিকার বাজার ছাড়িয়ে ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করেছে। তৈরি পোশাকের পর এখন ওষুধ শিল্পকে রফতানি আয়ের একটি অন্যতম খাত হিসেবে ধরা হচ্ছে। রফতানি আয়েও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে। গত অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৬শ কোটি টাকা আয় হয়েছে এ শিল্প থেকে।রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, সদ্যসমাপ্ত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ওষুধ রফতানির পরিমাণ বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে ওষুধ রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ কোটি মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৮ কোটি ২১ লাখ ডলার; যা দেশি মুদ্রায় প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। আগের বছর আয় ছিল ৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার বা ৫৬৬ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ খাতে আয় ছিল ৪ কোটি ৮২ লাখ ডলার বা ৩৭৫ কোটি টাকা।খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে কিছু আইনি ও নীতিগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এগুলো দূর করতে পারলে বিশ্ববাজারে ওষুধ রফতানির বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। সরকারি সহায়তা পেলে এ বাজার ২০ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। দেশের অনেকগুলো ওষুধ কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে ওষুধের মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আনতে হয় চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। যেখানে প্রচুর টাকা চলে যায়। বাংলাদেশে যদি এই কাঁচামাল তৈরি করা যায়, তাহলে দেশের টাকা দেশেই থাকবে এবং প্রস্তুতকৃত ওষুধ দেশের বাইরে রফতানি করলে বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করাও সম্ভব।রফতানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে বাংলাদেশের ওষুধের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। এখন বিশ্বের ৮০টি দেশে এ দেশের ওষুধ রফতানি হয়ে থাকে। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাজার ধরতে পারলে তা ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকো, স্কয়ার যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রফতানির জন্য নিবন্ধন পেয়েছে। এখন রফতানির অপেক্ষা। আর ইনসেপ্টার নিবন্ধন পাওয়া চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১০৫টির বেশি দেশে এ দেশের ওষুধের বাজার রয়েছে। এসব দেশে প্রায় ২শ ধরনের ওষুধ যাচ্ছে। বাংলাদেশের ওষুধ সেখানে সমাদৃত হচ্ছে। ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস বা জিএমপি অনুসরণ করতে হয়। শর্তগুলো সম্প্রতি আরো কঠিন হয়েছে, যা সিজিএমপি বা কারেন্ট গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস নামে পরিচিত। আশার কথা, বাংলাদেশের ওষুধ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এই শর্তগুলোও পূরণ করতে পেরেছে। অর্থাৎ মানের কারণেই এ দেশের ওষুধের বাজার বাড়ছে।ওষুধ শিল্পের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ওষুধ শিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। তাই মূল্যবান এ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে হলে প্রস্তাবিত কাঁচামাল উৎপাদনের শিল্পপার্ক নির্মাণে হাত দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ ওষুধ তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনে যাওয়ার জন্য এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার ওষুধ শিল্পপার্ক স্থাপন শেষ হলে এখানেই ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদিত হবে, আগামীতে ওষুধ রফতানি আরো বাড়বে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ছাড় এ দেশের ওষুধ শিল্পের জন্য বিশেষ সুযোগ নিয়ে এসেছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ওষুধ রপ্তানি বিশ্বের প্রতিটি দেশে নিয়ে যেতে হবে। এজন্য চাই এ শিল্প বিকাশে সব ধরনের সরকারি সহযোগিতা ও রফতানিতে নগদ আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রণোদনা।বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় আড়াইশ প্রতিষ্ঠান অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুত করছে। এসব কারখানায় বছরে ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ উৎপাদিত হয়। কারখানাগুলোর মধ্যে বেশ কিছু কারখানা আন্তর্জাতিক মানের। বিশেষ করে স্কয়ার, বেক্সিমকো, রেনেটা, ইনসেপটা, হেলথ কেয়ার, এসকেএফ, সেনডোজসহ বিভিন্ন কারখানা আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ উৎপাদন করে। বিশ্বমানের ৪২টি এমন ওষুধ কারখানায় উৎপাদিত কোটি কোটি টাকার ওষুধ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও জাপান, কোরিয়া, আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশে বছরে প্রায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধ তৈরির কাঁচামাল উৎপাদিত হচ্ছে।এদিকে গত জুনে দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে কুয়েত বা উপসাগরীয় অঞ্চলের (গালফ) কোনো দেশে ওষুধ রপ্তানি শুরু করেছে বেক্সিমকো ফার্মা। দেশটিতে আগামী ৫ বছরে প্রায় শতকোটি ডলারের ওষুধ বিক্রির আশা করছে কোম্পানিটি। কুয়েতের বাজারে প্রবেশের মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, গালফ, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশের বাজারে ওষুধ রপ্তানির সূচনা হয়েছে বলেই মনে করছেন ওষুধ ব্যবসায়ীরা।এমএ/এনএফ/আরআইপি

Advertisement