আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জঙ্গিবাদের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক, বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ, শিক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্র-সমাজের দায়- এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। পরীক্ষানির্ভর শিক্ষার কারণেই নৈতিক শিক্ষা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কারণেই শিক্ষার্থীরা অন্ধকারে পা দিচ্ছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। আজ এর শেষ পর্ব। জাগো নিউজ : শিক্ষা নিয়ে নানা উদ্যোগের কথা শোনাচ্ছে সরকার। পরিবর্তনের কথা বলেন আপনারাও। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য ভয়াবহ পর্যায়ে ঠেকেছে। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি? আরেফিন সিদ্দিক : শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য এ নীতি কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যায় না। সমাজের একশ্রেণির মুনাফালোভী মানুষ শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্যকে গুলিয়ে ফেলছে। একজন শিক্ষা অনুরাগীর আরো ব্যবসা থাকতে পারে। সেখান থেকে তিনি মুনাফা অর্জন করতেই পারেন। কিন্তু শিক্ষায় যদি তিনি বিনিয়োগ করতে আসেন, তখন সেটা মুনাফার ঊর্ধ্বেই রাখা উচিত। শিক্ষায় বিনিয়োগ সমাজের জন্য, মানুষের জন্য। আমরা যখন জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা করছি, তখন বারবার কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সামনে আসছে। এটি খুবই দুঃখজনক। যেখানে তাদের মানুষের মতো মানুষ হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী যদি মানুষ হত্যা করে, তখন সঙ্গত কারণে এই শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষা আন্দোলন যেন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। জাগো নিউজ : তাহলে কি শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে রাষ্ট্রের কোনো ঘাটতি আছে? আরেফিন সিদ্দিক : এই অনিয়ন্ত্রণ ধারাবাহিকভাবেই হয়ে আসছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দায় রয়েছে। কিন্তু যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন তাদের দায়টাই সর্বাগ্রে। এখানে যারা শিক্ষকতা করেন, তাদের মানসিকতার ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করে।জাগো নিউজ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুই হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়ে। এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষক এখানে পড়াচ্ছেন।আরেফিন সিদ্দিক : আজকের শিক্ষাব্যবস্থার যে পরিস্থিতি তার দায় সবার। এককভাবে সরকারকে দোষারোপের কোনো সুযোগ নেই। যারা এখানে শিক্ষা দান এবং পরিচালনা করছেন, তাদের দায়িত্ববোধের বিষয়টি সবার আগে গুরুত্ব পাবার কথা। জাগো নিউজ : জঙ্গিবাদের অভিযোগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধেও। হিজবুত তাহরীরের প্রধান ঢাবির শিক্ষক...আরেফিন সিদ্দিক : ঢাবিতে প্রায় দুই হাজার শিক্ষক রয়েছেন। সবাইকে তো নজরদারিতে রাখা যায় না। যে দু-একজন অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা কারাভোগের পর জামিন পেয়েছেন। তবে এখনো পাঠদানের অনুমতি দেয়া হয়নি। আদালত চূড়ান্ত রায় দিলেই তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে । একইভাবে শিক্ষর্থীদের ব্যাপারেও সজাগ রয়েছি। এটি জাতীয় সমস্যা এবং সেভাবেই দেখা উচিত। জাগো নিউজ : যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছে এর মধ্যে দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসলে ভবিষ্যৎ কি? আরেফিন সিদ্দিক : পরিস্থিতি উপলদ্ধি করতে পারলেই সমাধান বেরোবে। আজকের যে বাংলাদেশ তা শিক্ষার আলোর মধ্য দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি করবে এবং কি পদ্ধতিতে করবে তা এখনই ঠিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) আরো সোচ্চার হতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষা বিস্তারে সমাজের শিক্ষা অনুরাগী বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। মুনাফার সঙ্গে এক করে না দেখে ব্রত হিসেবে নিয়ে শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে। আগে সমাজের বিত্তবানরাই শিক্ষা বিস্তারে অধিক ভূমিকা পালন করছে। শত শত একর জমি দান করেছে। কলেজ ফান্ড দিয়েছে। এখন কেউ এগিয়ে আসছে না। জাগো নিউজ : সমাজ সেই বাস্তবতা এখন ধারণ করে? আরেফিন সিদ্দিক : হুবুহু হয়তো করে না। কিন্তু মানুষের মধ্যে এক প্রকার গতি আনতে হবে। আর এটি রাষ্ট্র, সমাজকেই করতে হবে। এই গতি আনতে সময় লাগবে। অনেক মানুষ আছেন যারা দান করে প্রচার করতে চান না। তাদের সামনে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। জাগো নিউজ : ঢাবি শিক্ষার্থীদের সচেতনতার কথা বলছিলেন। কিন্ত হল সংসদ, ছাত্রসংসদ নির্বাচন নেই। ছাত্ররাজনীতি দিন দিন বিতর্কিত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে যা হচ্ছে তা অপরাজনীতি। আরেফিন সিদ্দিক : আমরা বারবার উদ্যোগ নিয়েছি ছাত্রসংসদ নির্বাচনের। তবে বাস্তবতার নিরিখে সম্ভব হচ্ছে না। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগেরই ছাত্রত্ব নেই। এই অছাত্র দিয়ে ছাত্রসংসদের নির্বাচন করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাজনীতির কোনো লাভ হবে বলে মনে করি না। জাগো নিউজ : বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারতো? আরেফিন সিদ্দিক : বাস্তবতা সবারই জানা। আমি আমার ক্ষমতার মধ্য থেকে উদ্যোগ নিতেই পারি। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। সমস্যা হচ্ছে এখানেই। জাগো নিউজ : আপনি কি মনে করেন ছাত্ররাজনীতির আজকের যে পরিস্থিতি, তা কাউকে কাউকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে? আরেফিন সিদ্দিক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষায় এখন প্রায় শত ভাগ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি। তার মানে সব দলের শিক্ষার্থীরাই ক্যাম্পাসে সহাবস্থান করছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা হয়তো সেই অর্থে সহাবস্থান করতে পারছেন না। কিন্তু নিয়মিত ছাত্ররা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ডাকসুর কার্যক্রম নেই ঠিক, কিন্তু ছাত্ররা নিজ উদ্যোগে ক্যাম্পাসে বহু সংগঠন গড়ে তুলেছে, যেখানে সহশিক্ষা অর্জন করতে পারছে। বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ক্যাম্পাসে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে মানবিক গুণাবলি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকাশ হতে পারে, কিন্তু তা অর্জন করতে হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। আমাদের এ দিকটিতেই অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। জাগো নিউজ : সহাবস্থানের কথা বলছেন। কিন্তু হলে তো ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। হলে ছাত্রলীগের জুলুম সইতে না পেরে এক সাধারণ ছাত্রের আত্মহত্যার পর বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়। অভিভাবক হিসেবে তো এই দায় আপনারও?আরেফিন সিদ্দিক : প্রশাসন বিধি অনুযায়ী হলের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এরপরও নিয়মের বাইরে কিছু ঘটনা ঘটে, যা দুঃখজনক। তবে কোনো ঘটনা ঘটলেই হল প্রশাসন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু আসন সংখ্যা সীমিত থাকার কারণে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকে না। জাগো নিউজ : তার মানে এই সুযোগেই বিশেষ ছাত্রসংগঠন খবরদারি করতে পারে?আরেফিন সিদ্দিক : হলের আবাসিক সমস্যার সমাধান হলে ছাত্ররাজনীতি অনেকটাই ইতিবাচক জায়গায় চলে আসত। তবে এ সমস্যা একদিনে দূর করা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সমস্যা আপনি চাইলেই একদিনে সমাধান দিতে পারবেন না। জাগো নিউজ : সম্প্রতি ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের দ্বন্দ্বের জের ধরে ছাত্র ইউনিয়নের দেয়াল লিখন মুছে দিয়েছে ছাত্রলীগ- এমন অভিযোগ প্রচার রয়েছে। আরেফিন সিদ্দিক : বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের কাছে এখনো কেউ অভিযোগ করেনি বিধায় এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। জাগো নিউজ : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্মরণিকায় একটি লেখা নিয়ে ছাত্রলীগ আপনার গাড়িতে হামলা ও বাড়ি অবরুদ্ধ করে। এ নিয়ে কি বলবেন? আরেফিন সিদ্দিক : সিন্ডিকেট সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। জাগো নিউজ : ছাত্রলীগের বাইরে অন্য কোনো সংগঠন ওই হামলা করলে ব্যবস্থা নিতে কি এমন বিলম্ব হতো?আরেফিন সিদ্দিক : সব কিছু নিয়মের মধ্যে থেকেই করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। এ কারণেই একটু বিলম্ব। মামলা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। আশা করছি অচিরেই দোষীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জাগো নিউজ : স্মরণিকায় জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি লেখায় ঘটনার সূত্রপাত। এ নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত জানতে চাই? আরেফিন সিদ্দিক : আমার কাছে মনে হয়েছে এটি ষড়যন্ত্র। লেখা এবং পরবর্তীতে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড দুটোকেই আমি ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করছি। তবে এর রহস্য দ্রুত উদঘাটন করা হবে।এএসএস/এএইচ/এসএইচএস/পিআর
Advertisement