খেলাধুলা

রফিকের হাত ধরে জন্ম নিক ‘নতুন রফিক’

জালাল উদ্দীনের কথা খুব মনে পড়ছে। ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম ‘হ্যাটট্র্রিকম্যান’। পাকিস্তানের এই সাবেক ফাস্ট বোলার আট বছর আগে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করো না, তোমাদের বাংলাদেশেও ভালো ভালো ক্রিকেটার জন্মাবে। উঁচু ও বিশ্বমানের ব্যাটিং প্রতিভার উন্মেষ ঘটবে। প্রতিপক্ষ শিবিরে কাঁপন ধরানো ফাস্ট বোলার তৈরি হবে এবং এমন স্পিনার বেরিয়ে আসবে, যাকে খেলতে বিশ্বের অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যানেরও নাভিশ্বাস উঠে যাবে।’ মোহাম্মদ রফিক নতুন প্রজন্মকে স্পিন শেখানোর আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব নেয়ায় আসলে ওই পাকিস্তানির কথা মনে পড়ল। ক্যারিয়ার আহামরি নয়। এক কথায় সাদামাটা। খুবই ছোট্ট- সাকুল্যে ৬ টেস্ট আর ৮ ওয়ানডে খেলেছেন; কিন্তু একটি বিরল কৃতিত্বের কারণে এখনো স্মরনীয়। ওয়ানডে ক্রিকেট যতদিন থাকবে হয়ত তার নামও ততদিনই স্বর্ণাক্ষওে লেখা থাকবে। ১৯৮২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হায়দারাবাদের নিয়াজ স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে পরপর তিন বলে রডনি মার্শ, ব্রুস ইয়ার্ডলি ও জিওফ লসনকে আউট করে ইতিহাস রচনা করেছিলেন সিন্ধের সাবেক এ ফাস্ট বোলার। বলার অপেক্ষা রাখে না, একদিনের ক্রিকেট ইতিহাসে সেটাই প্রথম হ্যাটট্র্রিক। ২০০৮ সালে পাকিস্তান সফরে কথা হয়েছিল তার সাথে। জালাল উদ্দীন বলেছিলেন, ‘শোনো, তোমরা সবে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছো। এই টেস্ট এবং ওয়ানডেতে যারা খেলছে, তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্ম যখন খেলা ছেড়ে কোচিং করাবেন, তাদের হাতে দেখবে আরও মেধাবী, আরও বড় প্রতিভা জন্ম নেবে। যারা টেস্ট এবং ওয়ানডে খেলে তারপর কোচিংয়ে জড়াবেন, তাদের শেখানোর কায়দা-কৌশল হবে ভিন্ন। টেস্ট ক্রিকেট কী? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মেজাজ, ধরন, গতি- প্রকৃতি, কৌশল, লক্ষ্য, পরিকল্পনা সবই তাদের মোটামুটি জানা থাকবে। সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা যা শেখাবেন, তা নিশ্চয়ই আগের প্রজন্মের কোচদের চেয়ে যুগোপযোগি এবং লাগসই হবে। অপেক্ষা করো, দেখবে তোমাদের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের টেস্ট ক্রিকেটার এবং বিশ্ব ক্রিকেটে খেলা ক্রিকেটারদের হাত ধরে নতুন নতুন প্রতিভার জন্ম নেবে।’ এমন নয়, এই আট বছরে বাংলাদেশে নতুন প্রতিভা জন্ম হয়নি। হয়েছে। মুমিনুল, সৌম্য, লিটন, মোস্তাফিজ, তাসকিনরা বেরিয়ে এসে আলো ছড়াচ্ছেন; কিন্তু জালাল উদ্দীন যাদের কথা বলেছিলেন, তাদের কারো হাত ধরে জন্ম হয়নি ওসব প্রতিভার। তারা অন্যভাবে উঠে এসেছেন। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট এবং ওয়ানডে খেলা প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মর হাত ধরে সে অর্থে ভালো কোনো প্রতিভার জন্ম হয়নি এখনও। কী করে হবে? ওই প্রজন্মর ৯০ শতাংশ সাবেক ক্রিকেটার যে কোচিং থেকেই দূরে! যাদের হাতের ছোঁয়ায় বড় ব্যাটসম্যান তৈরি হতে পারে, যারা কোচিংয়ে জড়ালে দুর্দান্ত ফাস্ট বোলার ও বিশ্বমানের স্পিনার বেরিয়ে আসবে- সেসব ক্রিকেটারদের বড় অংশ অন্যত্র ব্যস্ত। বাংলাদেশ যখন থেকে টেস্ট খেলছে, তার প্রথম প্রজন্মের যারা ফ্রন্টলাইন ক্রিকেটার, তাদের মধ্যে খালেদ মাহমুদ সুজন আর খালেদ মাসুদ পাইলট ছাড়া সে অর্থে কেউই কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত নন। আমিনুল ইসলাম বুলবুল কোচিংয়ের পাশাপাশি ক্রিকেট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত, তবে দেশে উপেক্ষিত। আইসিসিই তার কর্মস্থল। এছাড়া বাংলাদেশের সব সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, আকরাম খান, হাবিবুল বাশার, ফারুক আহমেদ, আতহার আলী, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, জাভেদ ওমর বেলিমের কেউ কোচিংয়ে জড়িত নন। এর মধ্যে নাঈমুর রহমান দুর্জয় পুরোদস্তুও রাজনীতিতে জড়িয়ে এখন সরকারী দলের সাংসদ ও ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক। দেশের ক্রিকেটের সফল সেনাপতি, যার হাত ধরে ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতেছিল বাংলাদেশ, সেই আকরাম খানও এখন বোর্ড ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। তুখোড় ফাস্ট বোলার হাসিবুল হোসেন শান্ত, আনিসুর রহমান, স্পিনার আজহার হোসেন শান্টু, এনামুল হক মনি ও মোহাম্মদ রফিকের কেউই সে অর্থে ক্রিকেটার গড়ার কারিগর হননি। মিনহাজুল আবেদিন মাঝে একবার অনুর্ধ্ব-১৯ দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেই ইতি টেনেছেন। ফারুক-বাশারের মতো তুখোড় উইলোবাজরা নির্বাচক। আতহার আলীর মতো টেকনিক্যালি সাউন্ড ব্যাটসম্যান, কোচিংয়ে না জড়িয়ে ধারাভাষ্যকার। দেশের অন্যতম সফল বাঁ-হাতি স্পিনার এনামুল হক মনি স্পিন একাডেমি না গড়ে আম্পায়ার। বাঁ-হাতি পেসার আনিসুর রহমানও পেস বোলার তৈরির কাজে না গিয়ে আম্পায়ারিংকে পেশা হিসেবে নিয়ে ফেলেছেন। এসব গুণী ক্রিকেটাররা কোচিংয়ে থাকলে তাদের পরিচর্যায় যারা বেরিয়ে আসতেন, তাদের ভিত অবশ্যই আরও বেশি মজবুত থাকতো। মিনহাজুল আবেদিন নান্নু যেভাবে শত প্রতিকুলতায়ও মাথা ঠান্ডা রেখে পরিবেশ- পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেন, অযথা চার-ছক্কার ফুলঝুড়ি ছোটানোর বদলে গ্যাপ শটে ইনিংস সাজাতেন- তার ছাত্র হলে অমন কারো দেখা মিলতো; কিন্তু কই? তেমন একটি নান্নুর দেখা কি মিলেছে? আকরাম খানের পাহাড় সমান দৃঢ়তায় ব্যাট চালানোর কেউ নেই এখন। দুর্জয়ের মত অফস্পিনার কাম মিডল অর্ডারও সে অর্থে নেই। এরা যদি কোচিং করতেন তাহলে তাদের হাত দিয়ে অবশ্যই আরও মেধাবি এবং কার্যকর ক্রিকেটারের দেখা মিলতো। যিনি হতে পারতেন এদেশের স্পিনার গড়ার প্রধান কারিগর, সেই মোহাম্মদ রফিকও দীর্ঘ দিন ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন। মাঝে ক্লাব ও বিপিএলে একটু আধটু কোচিং করিয়েই শেষ; কিন্তু স্পিনারদের ট্রেনিং করানো বলতে যা বোঝায়- রফিক তা করেননি। অনেক দেরিতে হলেও এ অসাধারণ স্পিনারকে এইচপিতে জড়ানো হয়েছে। এইচপির স্পিনারদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব বর্তেছে তার ওপর। একাডেমিক শিক্ষা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই। ছিলেন পেসার। পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার ওয়াসিম হায়দারের পরামর্শে দ্রুতগতির বোলিং ছেড়ে নয়, নিজের চেষ্টায় ফাস্ট বোলার থেকে স্পিন শুরু করে রফিক হয়েছেন দেশসেরা। নিখুঁত লাইন ও লেন্থে বল ফেলা এবং ফিল্ডিং অনুযায়ী বোলিং করায় এখনো তার জুড়ি মেলা ভার। রফিকই পারবেন, এখনকার তরুণ- যুবাদের হাত ধরে টাইট বোলিং শেখাতে। উইকেটের সুবিধা না পেলেও কিভাবে বাড়তি টার্ন করানো যায়, ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা বুঝে কখন আর্মার ছুড়তে হবে। ফ্লাইটে বৈচিত্র এনে ব্যাটসম্যানকে সামনে এগিয়ে আনা ও পিছনের পায়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করা- রফিকের চেয়ে ভালো আর কেই বা  শেখাতে পারবেন? দেশ সেরা বাঁ-হাতি স্পিনার রফিকের হাত ধরে আগামীতে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন রফিকের দেখা মিলুক এটাই প্রত্যাশা সবার।জাগো চ্যাম্পিয়নের অষ্টম সংখ্যা সম্পূর্ণ পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে...আইএইচএস/পিআর

Advertisement