দেশজুড়ে

ভিক্ষা করে টাকা দিয়েছি এখন বলে অপেক্ষা কর

‘ভিক্ষা করে ৫২ হাজার টাকা রাখছি। সেই টাকা এখন দিচ্ছে না। এখন টাকা চাইলে বলে অপেক্ষা কর, ধৈর্য ধর, সহ্য কর। আমার যদি মৃত্যু হয়ে যায় তখন টাকা দিয়ে কী করবো’। এভাবে জাগো নিউজকে কথাগুলো বলছিলেন সাতক্ষীরা উপজেলার খানপুর গ্রামের ভিক্ষুক ফনিন্দ্র কুমার। নিজের জমানো টাকা ফিরে পাওয়ার জন্য জেলার পাটকেলঘাটা মজুমদার ফিলিং স্টেশন পেট্রোল পাম্পের পাশের এনজিও অফিস খোলার অপেক্ষায় বসে থাকেন ফনিন্দ্র কুমার।  অফিসের ভেতরে ঢুকতেই চোঁখে পড়ে শুধু ফনিন্দ্র কুমার-ই একা নয় বরং নিজের সঞ্চয় করা টাকা পাওয়ার অপেক্ষা করছেন আরো শত শত গ্রাহক।বিস্তারিত জানতেই বেরিয়ে এলো অধিক লভ্যাংশ, পাওয়ার ট্রলি, সেলাই মেশিন দেয়ার নাম করে মাঠকর্মীদের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সানলাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম সোলাইমান হোসেনের প্রতিষ্ঠান ‘এইচএস এডুকেশন অ্যান্ড হেলথ সোসাইটি’। গ্রাহকদের তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিস বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছে সংস্থাটির পরিচালক। পাটকেলঘাটা পেট্রলপাম্প এলাকায় আব্বাস আলীর বাড়ি ভাড়া নিয়ে সানলাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানির নামে চালানো হয়েছে অফিস কার্যক্রম। কিন্তু তাদের দেয়া চাঁদা আদায়ের পাশ বইতে উল্লেখ রয়েছে প্রমিনেন্ট সেভিংস অ্যান্ড ক্রেডিট এমসিএস লিমিটেড নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নাম। একই ব্যানারে দুটি প্রতিষ্ঠান। অফিসের সামনে নেই কোনো সাইনবোর্ড। তবে পেছনের দিকে রয়েছে ভাঙাচোরা একটি বিলবোর্ড।প্রতিদিন শত শত গ্রাহক অফিসে এসে ভিড় করলেও অফিস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা মেলে না কারও। মাঝে মধ্যে গ্রাহকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অফিসটি খুললেও গ্রাহকরা সেটি জানতে পারে না। কখনো যদি ম্যানেজার হাফিজুর রহমানের সঙ্গে গ্রাহকদের দেখা হয় তখন চুপিসারে তিনি ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। গ্রাহকরা টাকা চাইলে তিনি জবাব দেন, টাকা দেয়া হবে না এটা তো বলিনি। অপেক্ষা করেন টাকা ফেরত দেয়া হবে। এসব অভিযোগ করে তালার গোপালপুর গ্রামের আইজান বিবি জাগো নিউজকে বলেন, মাঠকর্মী সুজনশাহ গ্রামের আরতি রানী দাশের মাধ্যমে আমি ৫ বছর ধরে টাকা দিচ্ছি। কিন্তু এখন আমার টাকাটা নিয়ে ৭-৮ মাস ধরে ঘুরায়। ফেরত দিচ্ছে না। একেকদিন একেক ধরনের কথা বলে।  একই গ্রামের মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার কাছ থেকে টাকা এনে মাঠকর্মী শ্যামলী রায় ম্যানেজার হাফিজের কাছে দিয়েছে। হাফিজ সেই টাকা দিয়ে ট্রাক কিনেছে। এখন আমার টাকা দেয় না। গোপালপুর গ্রামের শংকর কুমার দাশ বলেন, আমাদের এলাকার ১০০ জন গ্রাহক আছে। এদের কাছ থেকে ৮০-৯০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া আশেপাশের গ্রামের সব মিলিয়ে গ্রাহক সংখ্যা ৫শ থেকে ৬ শতাধিক। সবার কাছ থেকে প্রায় তিন কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে তারা। আমার বাবার কাছ থেকে নিয়েছে তিন লাখ টাকা। টাকার জন্য আমার বাবা একবার স্ট্রোক করেছে। এখন অফিসটা বন্ধ তারা গা ঢাকা দিয়েছে। ভুক্তভোগী নাজমা বেগম জানান, ২০ হাজার টাকার এফডিআর খুলে নেয়। বলে কি ৭ বছর পরে ৬০ হাজার টাকা পাবা। আমার ৭ বছর হয়ে গেছে কিন্তু টাকা চাইতে এসে দেখি অফিস বন্ধ।  এ বিষয়ে বাড়ির মালিক আব্বাস আলী জাগো নিউজকে বলেন, সমাজসেবা নামক একটা কাজের কথা বলে আমার কাছ থেকে বাড়ি ভাড়া নেয়। প্রতিদিন গ্রাহকরা এসে ঝামেলা করে। আমি বলেছি, বাসা ছেড়ে দেন কিন্তু তারা বাসা ছাড়ছে না। আমার ভুল হয়েছে বিষয়টা আমি পুলিশকে জানায়নি। এইচএস এডুকেশন অ্যান্ড হেলথ সোসাইটি মাঠকর্মী শ্যামলী রায় বলেন, আমাকে বলেছিল আপনি যদি কিছু লোক দিতে পারেন। তবে আপনাকে কমিশন দেবো। আমাকে শতকরা ৩০ টাকা, পরে ২০ টাকা করে দিতো। মাঠকর্মী আরতি রানী দাশ বলেন, এদের কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। টাকা দিচ্ছে না বলে আমি প্রতিষ্ঠানের এমডি এম সোলাইমান হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। প্রতিদিন গ্রাহকরা আমার বাড়িতে এসে জড়ো হয়। আমি অসহায়ের মতো রয়েছি। এখন অফিসও ঠিকমতো খোলে না তারা। এইচএস এডুকেশন অ্যান্ড হেলথ সোসাইটি ও প্রমিনেন্ট সেভিংস অ্যান্ড ক্রেডিট এমসিএস লিমিটেডের পাটকেলঘাটা শাখার ম্যানেজার হাফিজুর রহমানকে অফিসে পাওয়া না গেলেও মুঠোফোনে জাগো নিউজকে তিনি জানান, আমি জীবনবীমা কর্পোরেশনে চাকরি করি। এখানে পার্টটাইম চাকরি করি। এমডি টাকা দেবেন না একথা বলেননি। কিন্তু টাকা দিতে একটু দেরি হচ্ছে।তিনি আরো বলেন, বর্তমান স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপির সানলাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের এমডি এম সোলাইমান হোসেনের প্রতিষ্ঠান এটি। যা এইচএস এডুকেশন অ্যান্ড হেলথ সোসাইটি ও প্রমিনেন্ট সেভিংস অ্যান্ড ক্রেডিট এমসিএস লিমিটেড আলাদা প্রতিষ্ঠান। তবে তিনি সঠিক গ্রাহক সংখ্যা কত তার কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এছাড়া তিনি বলেননি গ্রাহকদের কত টাকা প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা রয়েছে।পাটকেলঘাটা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তরিকুল ইসলাম বলেন, এ বিষয় নিয়ে কেউ কখনো অভিযোগ করেনি। তবে অভিযোগ পেলে ব্যাবস্থা নেয়া হবে।জেলা সববায় কর্মকর্তা শেখ নওশের আলী জাগো নিউজকে জানান, এই নামে নিবন্ধনকৃত কোনো সমিতি আমাদের নেই। তবে এ নামে কারা কাজ করছে তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করবো।এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রতিষ্ঠান মালিক সানলাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এম সোলাইমান হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও মোবাইল ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।  আকরামুল ইসলাম/এএম/পিআর/ এমএএস

Advertisement