যশোর পুলিশের তালিকাভুক্ত ‘কথিত জঙ্গি’ মুন্না নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে জঙ্গি তালিকার কারণে আলোচনায় থাকা মুন্না সোমবার ভোরে ফিরে আসায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এদিন দুপুরে মুন্না যশোর কোতোয়ালি থানায় উপস্থিত হয়ে জানান, বকাঝকা করায় মায়ের ওপর অভিমান করে তিনি দুই বছর আগে বাড়ি ছাড়েন। ঢাকায় চাকরি করে তার জীবন চলতো। একদিন আগে ঢাকায় তিনি বিয়ে করেছেন। বিয়ের পরই স্ত্রীকে নিয়ে যশোরে ফিরে এসেছেন। জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্দেহভাজন এই কথিত জঙ্গি নিখোঁজ কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্না (২৪) যশোর শহরের শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার আবদুস সোবাহানের ছেলে। সোমবার দুপুরে যশোর কোতোয়ালি থানায় হাজির হয়ে নিখোঁজের পরের ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। এর আগে গত ১০ জুলাই পরিবারের পক্ষ থেকে মুন্না নিখোঁজের বিষয়ে যশোর কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্না জানান, দুই বছর আগে ক্রিকেট খেলা দেখা নিয়ে তার মা বকাবকি করেন। ‘তোর মুখ আমি দেখতি চাইনে, তুই বাড়ি থাকলি আমার মরা মুখ দেখপি’ মায়ের এমন কথায় অভিমানে ঘর ছাড়েন মুন্না। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে এভাবে ঘর ছাড়ার পর আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না তার। ঢাকায় গিয়ে প্রথমে জিনজিরা এলাকায় ডেকোরেটরের দোকানে কাজ নেন। এরপর পুরান ঢাকার ইসলামবাগে মাইশা প্লাস্টিক কোম্পানিতে চাকরি নেন। এভাবেই কেটে যায় প্রায় দুই বছর। এরই মধ্যে সেখানে থাকার সুবাদে একই এলাকার ইয়াসমিন আক্তারের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে মেয়ের পরিবার বিষয়টি জানতে পারে। এরপর মেয়ের পরিবার থেকে বলা হয়, অভিভাবকরা না আসলে বিয়ে হবে না। এরপর গত শনিবার (২৩ জুলাই) মুন্না বাড়ি যোগাযোগ করে বিয়ের কথা জানান। দুই বছর পর ছেলের সন্ধান পেয়ে মুন্নার স্বজনরা ঢাকায় যান। এরপর ২৪ জুলাই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে।মুন্না জানান, বিয়ের জন্য দুই বছর পর বাড়িতে ফোন করেন তিনি। বিয়ে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে জানতে পারেন পুলিশের সন্দেহভাজন জঙ্গি তালিকায় তার নাম রয়েছে। এরপর শনিবার রাতে পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় চলে যান। রোববার দুই পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে পুরান ঢাকার ইসলামবাগ এলাকার মনির খানের মেয়ে ইয়াসমিন আক্তারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি।কামরুজ্জামান মুন্না বলেন, ২০০৯ সালে এইচএসসি পাসের পর সরকারি সিটি কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম। এরপর আর্থিক অনটনের কারণে লেখাপড়া করা হয়নি। ২০০৯ সালের পর থেকে আর কলেজেই যাইনি। দুই বছর আগে বাড়ি ছাড়ি। এর মধ্যে পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু মাঝে এলাকার এক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঢাকায়। তার কাছ থেকে পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছিলাম।কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্নার বাবা চা বিক্রেতা আবদুস সোবহান জানান, তার ছেলের সঙ্গে বাড়ির যোগাযোগ না থাকায় তারা থানায় জিডি করতে যান। কিন্তু পুলিশ তার ছেলেকে জঙ্গি বানিয়ে দিয়েছে। তার ছেলে জঙ্গি নয় বলে তিনি দাবি করেন। মা শিরিনা আক্তার কমলা বলেন, ‘সরকার বলেছে যাদের ছেলে নিখোঁজ তাদের থানায় জিডি করতি হবে। না হলি তাদের বাবা-মাকে ধরে নিয়ে আসবে পুলিশ। আমার ছেলে দুই বছর নিখোঁজ ছিল। তাই থানায় জিডি করেছিলাম। আমি কখনো বলিনি আমার ছেলে জঙ্গি। বলেছি আমার ছেলেকে বকাবকি করেছিলাম। এজন্য সে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে।’কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্নার নানীশাশুড়ি সখিনা বেগম বলেন, মুন্না পুরান ঢাকার ইসলামবাগের একটি প্লাস্টিক কোম্পানিতে চাকরি করে। ওই এলাকায় আমাদের বাসা। মুন্না ওই এলাকাতেই থাকে। আমার নাতনির সঙ্গে ওর সম্পর্ক হয়। বিষয়টি জানতে পেরে মুন্নাকে ডেকে বলি তোমার পরিবারের সদস্যদের খবর দাও। তারপর বিয়ের বিষয়টি পাকা করা হবে। পরে পরিবারের লোকজন হাজির হলে মুন্নার সঙ্গে নাতির বিয়ে দিয়েছি।এদিকে যশোর পুলিশ পাঁচজনের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়ে পোস্টার ছাপিয়েছে। রোববার সেই পোস্টার জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেছে। ওই পাঁচজনের একজন কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্না। পুলিশের তালিকাভুক্ত অপর চার সন্দেহভাজন জঙ্গি হলেন- যশোর সদর উপজেলার কিসমত নওয়াপাড়া এলাকার কাজী হাবিবুল্লাহার ছেলে ও সরকারি এমএম কলেজের ছাত্র কাজী ফজলে রাব্বি (২১), শার্শা উপজেলার শ্যামলাগাজি গ্রামের আওরঙ্গজেবের ছেলে মেহেদী হাসান জিম (১৯), যশোর শহরের ধর্মতলা এলাকার আবদুস সালামের ছেলে রায়হান (২১) ও মণিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের মৃত হাসান আলী গাজীর ছেলে জিএম নাজিম উদ্দিন ওরফে নকশা নাজিম (৪২)।জঙ্গি সন্দেহে পাঁচজনের পোস্টার ও তালিকা প্রকাশের পর মুন্না ফিরে আসার ঘটনায় পুলিশের এই তালিকা নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে পাঁচজনের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার তালিকা প্রকাশ করা হয়। এদের মধ্যে দুজনের পরিবার তথ্য দিয়েছে তাদের ছেলে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় জড়িয়ে পড়তে পারে। তাদের একজন মুন্না। পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে আইনগত সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। মুন্না ফিরে এসেছে। আমরা তার বিষয়ে তদন্ত করে দেখবো। যদি জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া যায়, তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, পরিবার যেহেতু জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে তথ্য দিয়েছিল, তাই পুলিশ প্রাথমিকভাবে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলো। এখন মুন্না ফিরে এসেছে, সেজন্য পুলিশের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে।এমএএস/এবিএস
Advertisement