বিশেষ প্রতিবেদন

বামপন্থীদের জায়গা দখল করছে বিএনপি-জামায়াত

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্যবিরোধী তত্ত্বচর্চা ও লড়াইয়ে সক্রিয় রয়েছেন। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ যে কোনো নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন তিনি। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব। দেশে মার্কসীয় অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি বিশেষ পরিচিত লেখক। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। আজ থাকছে শেষ পর্ব। জাগো নিউজ : আপনারা যারা প্রগতিশীল আন্দোলনে সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে ছাড় দিয়ে আসছেন। আর এ কারণেই অনেকে মনে করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এর জবাবে কি বলবেন? আনু মুহাম্মদ : এর ব্যাখ্যা রাজনৈতিক দলগুলোই ভালো দিতে পারে। তবে এ প্রশ্নে শেখ হাসিনার সরকার যে সুবিধা পায় তাতে সন্দেহ নেই। কারণ আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কর্মকাণ্ড নিয়ে কুখ্যাতি আছে। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে জামায়াত-বিএনপির বিপরীতে আওয়ামী লীগ নিজেকে অপরিহার্য করে তোলার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগ তার আচরণে বোঝাতে চায় যে, আমরা যদি না থাকি তাহলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি চলে আসবে।তারা কৌশলে এক প্রকার ভয়ের আবহ তৈরি করে। এ ভয় তৈরি করে যেকোনো রাজনৈতিক দল থেকে তারা অনেক বেশি সুবিধা নিচ্ছে। কৌশলী এই অবস্থান তৈরি করে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রবিরোধী অনেক নীতিই গ্রহণ করে চলেছে। জাগো নিউজ : এর দায় তো বামপন্থীদেরও? সুবিধা তো তারাও করে দিচ্ছে?  আনু মুহাম্মদ : হ্যাঁ। বামপন্থী শ্রেণি শক্তির রাজনীতিকে গুরুত্ব দেয়, সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির বিষয়টি যদি গুরুত্ব দেয় তাহলে এই সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা নয়। বামপন্থীরা যদি শ্রেণিগত লড়াইকে গুরুত্ব দিতো তাহলে আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি বিতর্ক সৃষ্টি করে কাউকে ছাড় দেয়ার কথা নয়। বামপন্থীদের নীতি হওয়ার কথা ছিল জনগণের স্বার্থে জনগণের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তন সাধন করা।  জাগো নিউজ : তাহলে কি জনস্বার্থ বামপন্থীদের কাছেও আর গুরুত্ব পায় না? আনু মুহাম্মদ : আমাদের সমাজের ট্র্যাজেডি এখানেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিরোধের মধ্যে সমাজ যখন আচ্ছন্ন, তখন অনেক বামপন্থী সংগঠনও এই ঘোরে আটকা। এমন পরিস্থিতিতে বামপন্থীরা মনে করে, আওয়ামী লীগের এই কাজের বিরোধিতা করলে যদি বিএনপি চলে আসে! এই কাজের বিরোধিতা করলে যদি জামায়াত বিশেষ সুবিধা পায়! জাগো নিউজ : এমন দ্বিধায় আসলে সমাজ কি পায়? আনু মুহাম্মদ : আওয়ামী লীগের কাজের বিরোধিতা করলে জামায়াত-বিএনপি সুবিধা পাবে এই দ্বিধায় যখন বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ভোগে, তখন বিএনপি-জামায়াতই পক্ষান্তরে বেশি লাভবান হয়। অর্থাৎ সহযোগিতার কথা বলে যারা আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রবিরোধী নীতির সমাচেলানা করে না, তখন বিএনপি-জামায়াতই বেশি সুবিধা পাচ্ছে। কারণ বামপন্থীদের জায়গা বিএনপি-জামায়াত দখল করে নিচ্ছে।বামপন্থীরা নিজেরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতো এবং জনআবেগকে গুরুত্ব দিতো তাহলে এতদিনে বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রকাশ পেত এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বামপন্থীদের হাতেই চলে যেত।জাগো নিউজ : রামপাল ইস্যুতে তো ঐক্য হওয়ার সুযোগ ছিল? আনু মুহাম্মদ : আমি মনে করি রামপাল ইস্যুতে বামপন্থীরা চিন্তার দিক থেকে অনেকটাই ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু মাঠে ঐক্যবদ্ধ হওয়াই হচ্ছে আসল কথা। তবে একটি ব্যানারের অধীনেই আন্দোলন করতে হবে, তা নয়। একই বিষয়ে চিন্তার মিল থাকলে আলাদা আলাদা প্লাটফরম থেকেও যুগপৎ আন্দোলন করা সম্ভব। জাগো নিউজ : এতো বিরোধিতার পরেও রামপাল চুক্তি। আসলে এমন চুক্তির মাধ্যমে সরকার জনগণের কাছে কি বার্তা দিতে চাইলো? আনু মুহাম্মদ : ভারতের ইচ্ছা পূরণে সরকারের একটা দায় আছে বলে আমি মনে করি। পুঁজির প্রশ্নে এখানে ভারতের এক প্রকার সম্প্রসারণের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের বাজার তৈরি, বিনিয়োগের জায়গাসহ সব কিছুতেই কর্তৃত্ব দরকার। সেই ভারতের ওপর যদি কোনো সরকার পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল থাকে, তাহলে তো তার পক্ষে স্বাধীন কোনো চিন্তা করা সম্ভব নয়। রামপাল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি চুপচাপ থাকতেন, আমি নিশ্চিত তখন আওয়ামী লীগের লোকজনই এই চুক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলতেন।কারণ যারা এ দেশে থাকবেন তারা সবাই এই চুক্তির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সুতরাং ভারতের দায় মেটাতেই রামপালের মতো রাষ্ট্রবিরোধী চুক্তি করে আসছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও ভারতের এক প্রকার ম্যানেজমেন্ট থাকছে। ভারতের এলএনজি, রিলায়েন্স, আদানির মতো বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে বিশেষ দায়মুক্তি আইনের মাধ্যমে চুক্তি করা হয়েছে। জাগো নিউজ : বাংলাদেশে ভারতের কর্তৃত্ব পুরনো। বাজারও তাদের দখলে। রামপাল ইস্যুতে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে জনমনে। এই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে নতুন করে ঝুঁকি নিয়ে ভারতের কি লাভ থাকতে পারে? আনু মুহাম্মদ : এটি আমারও প্রশ্ন। তবে আমার মনে হয়, সকারের প্রতি ভারতের আরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যই এই চুক্তিতে ঝুঁকি নিয়েছে তারা। ভারত জানে, নির্বাচন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর জনআস্থা নেই। এসব চুক্তি সম্পন্নের মধ্য দিয়ে বোঝাতে চায়, এই সরকারের প্রতি ভারতের বিশেষ সমর্থন আছে। তবে সুন্দরবনের গুরুত্ব বোঝার অক্ষমতা থেকেই সরকার এই চুক্তি করেছে। সরকারের মধ্যে দেশের মানুষের স্বার্থ বোঝার অক্ষমতা রয়েছে। দেশের সমাজ, পরিবেশ সবকিছুর সঙ্গে সুন্দরবনের সম্পর্ক রয়েছে তা উপলব্ধির ক্ষমতা রাখে না সরকার।জাগো নিউজ : সরকার তো বোঝাতে চায় আপনারা সকল ভালো কাজের বাধা। আপনাদের কারণেই উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা। আপনারা আজও জ্বালানি নিয়ে কোনো বিকল্প হাজির করতে পারেননি।আনু মুহাম্মদ : সরকার তার সুবিধার স্বার্থে এসব বলে। আমাদের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বিকল্প দেয়া আছে। জাতীয় কমিটির সাত দফাই হচ্ছে বিকল্প। আমরা গ্যাস রফতানির বিরোধিতা করেছি। আমাদের উন্নয়নবিরোধী বলা হয়েছে। সরকার যদি গ্যাস রফতানি করতে পারতো, তাহলে আজ দেশের অর্ধেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যেত। প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার বাড়তি তেল আমদানি করতে হতো। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানিকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেয়ার বিরোধিতা করেছিলাম। প্রমাণিত হয়েছে ওই কোম্পানি পুরোপুরি একটি জালিয়াত কোম্পানি। টাটার বিরোধিতা করেছিলাম। প্রমাণিত হয়েছে আমরাই ঠিক। ফুলবাড়ী আন্দোলন সফল সরকার নিজেই স্বীকার করছে। কনোকো ফিলিপস বিরোধিতা করেছিলাম। কোম্পানিটি কি করলো সবার জানা। এরকম প্রত্যেকটি আন্দোলনে আমাদের অবস্থান যে সঠিক ছিল, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। রামপালের ক্ষেত্রেও আমরা সঠিক। পৃথিবীতে এমন কোনো বিশেষজ্ঞ নেই যিনি রামপাল চুক্তির পক্ষে অবস্থান নেবেন। সুতরাং আমাকে ডেকে যদি সরকার বলে যে আপনি বিরোধিতা করছেন, আমি বলব, ‘আমরা এখনো যথেষ্ট বিরোধিতা করতে পারিনি।’ জোরালো বিরোধিতা যদি করতে পারি তাহলে দেশের এই অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব। জাগো নিউজ : রামপাল ইস্যুতে আন্দোলন নিয়ে কতটুকু আশাবাদী? আনু মুহাম্মদ : স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ বিষয়ে যেভাবে আন্দোলন হচ্ছে, তাতে আমি আশাবাদী, সরকার অবশ্যই এই চুক্তি বাতিল করবে। চুক্তি বাতিল করতে যত বিলম্ব করবে, ততই ক্ষতি হবে। সুতরাং চুক্তি বাতিলে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার এখনই সময়। চুক্তি বাতিল হলে সুন্দরবন রক্ষা পাবে। সুন্দরবন রক্ষা পেলে দেশ রক্ষা পাবে।এএসএস/এএইচ/এসএইচএস/আরআইপি/এমএফ

Advertisement