বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা প্রতিটি যুদ্ধরত বাঙালির দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল। ভারতের পরই যে দেশটির নাম আমরা উচ্চারণ করতাম সেটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেশটির প্রতি আমাদের মতো তরুণদের আগ্রহ আগে থেকেই ছিল। ১৯৬৬ সালে তাসখন্দ চুক্তির কথা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। তবে কখনও ভাবতে পারি নি অতো বড় দেশে কখনও যেতে পারবো। সেই সময়ে খুব কম সংখ্যক মানুষের পক্ষেই বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ঘটতো। বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাওয়ার বিষয়টি কেবল পিএইচডি ডিগ্রি লাভের ক্ষেত্রেই কারো কারো ভাগ্যে ঘটতো। স্নাতক পর্যায়ে ঘটার কথা ভাবাই যেত না। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবকিছু আমাদের কাছেই যেন বদলে গেল। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্যে সোভিয়েত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে ১৯৭২ সালেই শতাধিক শিক্ষার্থীর পড়াশোনার বৃত্তি প্রদান করে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে বেশ কিছু খবর ছাপা হয়। দেশের সেরা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা বৃত্তি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে যায়। তখন এটি সকল মহলে আলোচিত একটি বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই। আমার ক’জন বন্ধু সে বছরই বৃত্তি নিয়ে মস্কো চলে গেছে। এটি দেখে নিজের মধ্যেও কিছুটা আগ্রহ বেড়েছিল। তবে ১৯৭৪ সালে সুযোগ থাকার পরও মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকায় কোনো আবেদনই করা হয় না। সে বছর তিন শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী বৃত্তি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যায়। এদের বেশির ভাগই আমার ইয়ারমেট বন্ধুবান্ধব- যদিও আগে খুব একটা পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয় নি, মস্কোতে যাওয়ার পর নিশ্চিত হতে পেরেছি। তখন এসএসসি এবং এইচএসসির প্রাপ্ত নম্বর যোগ করেই বৃত্তির জন্য মেধা তালিকা তৈরি করা হতো। সরকারি ব্যবস্থাপনার বাইরেও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি বা বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির মাধ্যমে যে সব প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়া হতো তাতেও অগ্রাধিকার ছিল মেধা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা এবং আদর্শিকভাবে নিষ্ঠার বিষয়গুলো। অবশ্য চূড়ান্ত তালিকাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেই প্রকাশিত হতো। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে নিজের দ্বিধাদ্ব›দ্ব কাটিয়ে বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির দেওয়া বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করি। যদিও অর্থনীতি বিষয়ে এরিমধ্যে দু’বছর পড়াশোনা করেছি, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে অর্থনীতি বিষয়ে পড়তে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনার শর্ত ছিল-যা আমার ছিল না। তবে ইতিহাসের প্রতি আমি কিছুটা আগ্রহী ছিলাম, কয়েকজন শুভাকাক্সক্ষী উৎসাহও দিয়েছিলেন। তাই ইতিহাসে দু’টো বৃত্তি দেখে তাতেই দরখাস্ত করি। এসএসসি, এইচএসসির ফলাফল এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় আমি নির্বাচিত হলাম। ১৯৭৫ সালে প্যাট্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্যে সম্ভবত আমরা ৪০ জন বৃত্তি পেয়েছিলাম। এরপর যথারীতি গ্রেটিস পাসপোর্ট হাতে পেলাম, ২৮ জুলাই মস্কোর উদ্দেশ্যে এরোফ্লত বিমানে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দর ত্যাগ করি, ২৯ জুলাই সকাল বেলা মস্কো বিমানবন্দরে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি প্রতিনিধি দল আমাদেরকে বরণ করতে এসেছিল। সারা রাতের ঘুমহীন ও ক্লান্তির পর মনে হচ্ছিল দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে বাসে করে যখন রওনা হই তখন দুই পাশের গাছ-গাছালি, সবুজ দৃশ্য, প্রশস্ত রাস্তা-ঘাট, বড় বড় বাস, ট্রাম, যানবাহন, প্রায় জনমানবশূন্য আশ-পাশের দৃশ্য, কোথাও কোথাও উঁচু উঁচু এ্যাপার্টমেন্ট- সত্তরের দশকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বিশ-একুশ বছরের তরুণ হিসেবে আমাদের কাছে ছিল এক মহাবিস্ময়। আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হোস্টেলে নিয়ে এক সপ্তাহ রাখা হলো। মূলত স্বাস্থ্য পরীক্ষার নানা ধরনের ডাক্তারি চেকআপ, ডাক্তারদের পরামর্শ ইত্যাদি ছিল বেশ নিবিড়ভাবে। তাছাড়া আবহাওয়া, খাওয়া-দাওয়া- এসবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা জরুরি ছিল। এরপর ভাষা শিক্ষার জন্য এক বছরের জন্যে নির্দিষ্ট হোস্টেলে ওঠা। এটি এক নতুন অভিজ্ঞতা। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার তখন প্রায় ১০০টি দেশের ছাত্র-ছাত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে পড়তে আসতো। হোস্টেল কক্ষে এরা একসঙ্গেই থাকতো। একজন রুশ এবং একজন ফিলিস্তিনি মিলিয়ে আমরা তিনজন এক কক্ষে সিট পেলাম। মূলত দ্রুত রুশ ভাষা শেখার জন্যেই বিদেশিদের এভাবে রুশ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করা। এটি সফল একটি পরীক্ষিত ব্যবস্থা। আমরা দ্রুতই একে অন্যকে জানা এবং কথা বলতে শুরু করি। ১৫ আগস্ট ভোর বেলা রুমে ফিট করা ছোট রেডিওটিতে সকালের খবর শুনতে গিয়েই রুশ কক্ষসাথী মিখাইল লাফ দিয়ে উঠে আমাকে কী যেন বোঝাতে চেষ্টা করছিল। সে ইংরেজি মোটেও জানতো না। পাশের কক্ষে একজন রুশ ছাত্র ছিল, সে ভালো ইংরেজি জানতো। তাকে মিখাইল ডেকে এনে আমাকে প্রথম দুঃসংবাদটি শোনালো। দ্রুত আশপাশের কক্ষে থাকা সকলেই বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার দুঃসংবাদটি শুনে আমরা মুষড়ে পড়েছিলাম। পাশের হোস্টেলগুলোতে যে সব সিনিয়র বাঙালি বন্ধু ছিলেন তারাও হোস্টেল থেকে বের হতে থাকেন, কেউ কেউ রেডিওতে বিবিসি শোনার চেষ্টা করলেন। সন্ধ্যায় আমরা অনেকেই ৮ নম্বর হোস্টেলের একটি রুমে একটি প্রতিবাদ সভায় মিলিত হই। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পেছনে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রকারী শক্তির গভীর নীল নকশার বাস্তবায়নের বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। আমাদের বিদেশ বিভূঁইয়ে আসার পরপরই দেশে সামরিক শাসনের উত্থান আমাদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। আমাদের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, ভিন্ন মতাদর্শের যে দু’চারজন ছিল তারা চুপচাপই ছিল। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই ছিল প্রগতিশীল চিন্তাধারার, রাজনীতি সচেতন। ফলে দেশকে নিয়ে ভাবা, দেশে ফেবার চিন্তা, নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি খুব সহজেই আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠে। সেই সময় মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত ছিলেন শামসুল হক। তিনি ক্যাডার সার্ভিসের ছিলেন না, বরং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তাই তিনি আমাদেরকে সহজেই গ্রহণ করেছিলেন। যতদিন তিনি মস্কো দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত ছিলেন ততদিন যে কোনো আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুর নাম তিনি স্মরণ করতেন। আমরা তাকে আমাদের একজন আপনজনই মনে করে তার কাছে ছুটে যেতাম। ১ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নে শিক্ষাবর্ষ শুরুর দিন। সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই দিন থেকেই পড়া-লেখা শুরু হয়। আমরা ব্যাগ ভর্তি খাতা ও বই নিয়ে ক্লাসে গেলাম। প্রথম ছয় মাস রুশ ভাষা শেখা, পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় সোভিয়েত ইতিহাসের ক্লাস। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পরীক্ষা। এরপর ১৫ দিনের শীতের ছুটি। শীতকালীন ছুটিতে আমাদের ১০ দিনের জন্যে লেনিনগ্রাদ শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বাল্টিক সাগরের তীরে বরফ ঢাকা কিছু অবকাশ যাপনের এলাকা রয়েছে, সম্ভবত জায়গাটির নাম জেলিনাগোরসক উপশহর। থাকা খাওয়া, শীতে স্কি করা, বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ইনডোর গেম্স এবং আশাপাশের নানা জাদুঘর এবং লেনিনগ্রাদ শহরের ঐতিহাসিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া-এ সবই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবারের মতো পালন করছিল। আমাদের বেশ ভালো লাগলো। দেশ ছেড়ে আসার পর বিরতিহীন লেখাপড়ার চাপের পর ১০ দিন বিশ্রাম, আর ঐতিহাসিক জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগটি ছিল অকল্পণীয় ব্যাপার। এরপর আবার মস্কোয় ক্লাসে ফিরে আসা। ফেব্রæয়ারি মাসের প্রথম সোমবার ক্লাস শুরু। দ্বিতীয় সেমিস্টারে চাপ অনেকটাই বেড়ে গেল, বিষয়ের প্রস্তুতিমূলক কোর্সগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও রুশ ভাষায় সব কিছু রপ্ত করা মোটেও সহজ ছিল না। তবে শিক্ষকদের পাঠদানের দক্ষতা, বন্ধুসুলভ আচরণ, ম্যাডামদের আদর-স্নেহ, পড়া আদায় করে নেওয়ার অনবদ্য কৌশল-সত্যিই বিস্ময়কর। জুন মাসের মাঝামাঝি কোর্স শেষে পরীক্ষা শুরু, ১ জুলাইয়ের আগেই তা শেষ করার নিয়মে কখনো ব্যত্যয় ঘটতে দেখি নি। সেমিস্টারের দীর্ঘ এই সময়ে ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস এবং ৯ মে ফ্যাসিবাদের ওপর বিজয় দিবস ছাড়া আর কোনো ছুটি ছিল না। ক্লাসে অনুপস্থিতি মোটেও সহ্য করা হতো না, অসুস্থ হলে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসার কাগজ ছাড়া কর্তৃপক্ষ ক্লাসে অনুপস্থিতি মোটেও বরদাশত করতো না। নিয়ম ভঙ্গ করলে প্রথমে সতর্ক করে দেওয়া হতো, পরে বৃত্তির অর্থ থেকে জরিমানা কাটা, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ এবং পরীক্ষায় অসাফল্যজনক কিছু হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম ছিল। পড়ালেখার জন্যে হোস্টেলের নিয়ম মেনেই সবাইকে চলতে হতো। কোনো ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা সহ্য করা হতো না। নিজেদের রুম নিজেদেরই নিয়মিত পরিষ্কার করতে হতো। কক্ষসাথীরা পালা করেই নিজেদের রুম পরিষ্কার রাখতাম। কক্ষসাথীর লেখাপড়া বা ঘুমে ব্যাঘাত হয়- এমন শব্দ করা নিষিদ্ধ ছিল, কক্ষসাথীর অনুমতি নিয়েই কোনো অতিথিকে রুমে আনা, আড্ডা দেওয়া সম্ভব ছিল। হোস্টেলের প্রতি তলাতেই কিচেন রয়েছে। রাতে নিজের মতো করে কিছু রান্না করার ব্যবস্থা ছিল, রুমে ফ্রিজ রাখতে বাধা ছিল না। ফলে রুমে কমবেশি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা প্রায় সকলেই করতো। নিজের পড়ার টেবিল ও আলমিরা নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই থাকা যেতো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে হোস্টেল চার্জ কাটা হতো না। অন্যত্র শুনেছি মাসে তিন রুবল কাটা হতো। জুলাই-আগস্ট দুই মাস গ্রীষ্মের ছুটি। এর আগে পরীক্ষা হয়ে যেত। ছুটিতে তিনটি উপায়ে সময় কাটানো যেতো। এক- দেশে বেড়াতে যাওয়া, দুই- ছাত্র ব্রিগেডে যোগ দিয়ে কাজাকস্তান, সাইবেরিয়া অথবা নিজ শহরে নির্মাণ কাজে অংশ নিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করা, তিন- বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে শিক্ষা সফর অথবা সমুদ্র তীরে অবকাশ কাটানো। আমি গোটা এক দশকে মাত্র দু’বার দেশে এসেছিলাম, একবার কাজাকস্তান, একবার সাইবেরিয়ায়, দুই বার মস্কোতে নির্মাণ কাজ এবং কারখানায় চল্লিশ দিন কাজ করে কিছু অর্থোপার্জন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। অবশ্য কৃষ্ণ সাগরের তীরে দু’বার বিশ্রাম নিতে গিয়েছি, ঘুরেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাসফর টিমে। শীত ও গ্রীষ্মের ছুটিতে এসব আয়োজনের ব্যবস্থা থাকতো। বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমাদের সোভিয়েত ইউনিয়নব্যাপী বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠনের বার্ষিক সম্মেলনসহ নানা কাজে আমার যাওয়া হয়েছে ছোট বড় ৩৪টির মতো শহর-উপশহরে। বলতে গেলে ১০টির মতো প্রজাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু এলাকা ঘুরেছি। তাসখন্দ, সমরখন্দ, আশহাবাদ, চারঝু, ক্রিমিয়া, রিগা, তাল্লিন, ভিলনুস, মিনস্ক, কিয়েভ, ক্রাসনাদার, খারকোভ, আলমাতা, ইভানোভা ইত্যাদি প্রসিদ্ধ শহর ঘোরার সুযোগ হয়েছে। এ সবই কেবল ছুটিকালে হয়েছে। সেমিস্টার যথারীতি শুরু হওয়ার পর ক্লাস, লাইব্রেরি, হোস্টেল- পড়াশোনা ছাড়া খুব বেশি সময় পাওয়া যেতো না। কেননা, এখানে ক্লাসে প্রফেসর যা লেকচার দিতেন, তা রুটিন অনুযায়ী আদায় করে নিতেন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক। ক্লাসে পড়াশোনা শিখে যেতে হতো। একেবারেই হাতে কলমে শেখানোর মতো, কোনো বিশেষ খাতির কারো জন্যে দেখি নি। লেখা-পড়া লেখাপড়াই। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হতো না। ফলে দ্রুত শেখার সমস্যা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি জটিল তাত্ত্বিক বিষয়সমূহের ওপর শিক্ষার্থীর দক্ষতা গড়ে উঠতো, শিক্ষকগণ সবকিছুতে নজর রাখতেন, সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেন। এভাবেই লেখাপড়ায় আমাদের জড়িয়ে থাকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না, প্রয়োজনও পড়ে নি। স্বীকার করতেই হবে, সোভিয়েত ইউনিয়নে উচ্চ শিক্ষা লাভে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। কিছু না শিখে ডিগ্রি পাওয়ার কথা কল্পনা করাও যায় নি। গবেষণার সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষার্থীকেই যুক্ত করে দেওয়া হতো। প্রথম বর্ষ থেকেই একজন শিক্ষকের সঙ্গে কোর্স ওয়ার্ক করতে হতো। ৫ম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষা শেষে মাস্টার্স থিসিস লেখা বাধ্যতামূলক। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত ইতিহাস গ্রন্থাদি নিয়ে প্রথম বর্ষের কোর্স ওয়ার্ক থেকে মাস্টার্স থিসিস করেছি। মাস্টার্সে ডিগ্রি অর্জনের পরপরই পিএইচডি করার সুযোগ পেলাম। সেটি শেষ করে ১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে দেশে ফিরে আসি। ১৯৭২ সাল থেকে মস্কো এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় ৪০টির মতো শহরে যে ছোট ছোট বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল সেটি বোধ হয় বেশ কৌতূহল সৃষ্টি করার মতো বিষয়। ষাটের দশকেও দু চারজন বাঙালি মস্কোতে গোপনে পড়তে এসেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর কাজী সালেহ আহমেদ তাদের অন্যতম। অকাল প্রয়াত ডাক্তার সেলিমও তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। তবে ১৯৭২ সালে সোভিয়েত সরকারের বৃত্তি নিয়ে যারা আসেন তারাই হলেন এই ছোট ছোট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাতা-যাদের সঙ্গে ওই দেশের সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটতে থাকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটে এসব ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা শুরু করে। কোনো কোনো শহরে শুরুর দিকে মাত্র একজন কিংবা দুইজনও ছিলেন। শিক্ষকদের কাছে এসব বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন আগ্রহের মানুষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত সরকারের ভূমিকার কারণে সাধারণ মানুষ আমাদের দেশ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সুতরাং আমাদের ছাত্রী-ছাত্রীরা ১৯৭২- পরবর্তী সময়ে যখন তাদের শহরে পড়তে যায় তখন সকলেই আগ্রহভরে তাদের দেখেছেন। শিক্ষকরাও তাদের বিশেষ দৃষ্টিতে দেখেছেন। অধিকন্তু বেশিরভাগ বাঙালি ছেলেমেয়ের সহজ-সরল জীবন, আচার-ব্যবহার সকলকেই মুগ্ধ করতো। লেখাপড়াতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ভালো করছিলেন ধীরে ধীরে প্রতিবছর নতুন নতুন ছাত্র-ছাত্রী যুক্ত হতে থাকে। মস্কোর বাইরে লেনিনগ্রাদ কিয়েভ, রোস্তভ, মিনস্ক, আল মাতা, ক্রাসনাদার, খারকভ, ওদেসা, ভলগাগ্রাদ, লুভব, স্তাভরাপোল, তিবিলিসি, ইরেভান, ইভানোভা, ভারোনেঝ-ক্রমেই শহরের এই তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। তবে অন্যান্য শহরের চাইতে অনেক বেশি শিক্ষার্থী ছিল মস্কোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউটে। বেশির ভাগই ইঞ্জিনিয়ারিং ডাক্তারি কৃষি, বিভিন্ন বিজ্ঞান শাখা, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে। বেশিরভাগ বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নে অত্যন্ত ভালো লেখাপড়া শিখেছেন। দেশে এখন যে দিকেই তাকাই আমাদের সেই সময়ের বন্ধুরাই শিক্ষা, গবেষণা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ নানা জায়গায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অনেকেই পশ্চিমা দুনিয়াতেও পাড়ি জমিয়েছেন। বেশ উঁচু আসনে থেকেই তারা অবদান রেখে চলছেন। মস্কোয় আমরা শনিবার সন্ধ্যায় নিকটবর্তী বন্ধুদের নিয়ে একত্রিত হতাম, আড্ডা, রান্নাবান্নাসহ খাওয়া-দাওয়া করার মধ্য দিয়ে সপ্তাহের ক্লান্তি কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতাম। রবিবার বন্ধের দিনও অনেকটা তা-ই ছিল। তবে মস্কোসহ অন্যান্য শহরে বসবাসকারী শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং নিজেদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল। এটি একেবারেই অরাজনৈতিক সংগঠন। এর মাধ্যমে আমরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শহর এবং গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারির মতো জাতীয় দিবস উদযাপনের একটা নিয়মিত ব্যবস্থা করতাম। ফলে রোববারগুলোতে প্রায়ই আমাদেরকে সাংগাঠনিক সভা করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেওয়াসহ নানা কাজেই ব্যস্ত থাকতে হতো। প্রতি বছর সাংগঠনিক কমিটি করার জন্যে সভা, সম্মেলন ইত্যাদি করা হতো। সবাই দল বেঁধে এক এক বছর এক এক শহরে তিন চার দিনের জন্যে চলে যেতাম, হৈ হুল্লুড় করে ক’টা দিন কাটিয়ে আবার যার যার শহরে চলে আসতাম। তবে মস্কোতে প্রায়ই নানা ধরনের সেমিনারের আয়োজন করার মাধ্যমে নিজেদেরকে তৈরি করার কাজটি গুরুত্বের সঙ্গেই আমরা পালন করতাম। এখানে আমাদের বাঙালি ছেলে মেয়েদের অনেকেই নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছেন, আমরাই এসব বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন বেশ হৈ চৈ করে সম্পন্ন করেছি। কেউ কেউ রুশ বা অন্যান্য জাতির মেয়েদের বিয়ে করেছেন। পড়ালেখা শেষ করে বেশির ভাগই বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন, কেউ কেউ ফিরেও গেছেন, কেউ কেউ অন্য কোনো দেশেও কর্মসূত্রে চলে গেছেন। ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে ছাত্র বৃত্তির সুযোগটি কমে যায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর অনেকেই সেখানে থেকে যেতে থাকে। এরিমধ্যে সেখানে এক ভিন্ন চরিত্রের বাংলাদেশ গড়ে উঠতে থাকে- যেখানে এখন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে বলে শুনছি- যা দেখার সুযোগ হয় নি। তবে সত্তর এবং আশির দশকে আমরা যখন পড়াশোনা এবং গবেষণায় রত ছিলাম তখন বিশ্ব পরিসরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এক পরাশক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাবা হতো নির্ভরযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবে, টিকবে না- এটি অনেকে এখন যেভাবে দাবি করেন- তখন তাদের বলতে শুনিনি, আমরাও ভাবিনি। তবে দেশটার ভেতরে সমস্যা ছিল, পণ্য সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতা ছিল, মানুষের মধ্যে পশ্চিমের প্রতি দু’ধরনের প্রতিক্রিয়াই ছিল। মিখাইল গর্বাচেভ দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর পেরেস্ত্রইকা (পুনর্গঠন) এবং গ্লাসনস্ত (খোলা হাওয়া) তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। গোটা সোভিয়েত সমাজই নয়, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বই যেন সেই খোলা হাওয়া আর পুনর্গঠনের হাঁকডাকে নড়েচড়ে উঠতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ধেয়ে আসা মস্তবড় ঝড়ো হাওয়ার গতিবেগ রুখতে পারে নি কেউ। তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে গেল পৃথিবীর সব চাইতে বড় দেশটা- সবাই যেন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি! পৃথিবীর আরেক মহাবিস্ময়কর ঘটনা হয়ে এই সময়ের ইতিহাস হয়তো বিষয়টিকে দেখবে, বোঝারও চেষ্টা করবে। আপাতত সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতিহাসের বিষয় হয়ে আছে। কিন্তু এর সবই কি অতীত? সবই কি শেষ? অধরা? নাকি অন্যকিছু- আগামীতে হয়তো সেটিই বোঝা যাবে।লেখক : কলামিস্ট, অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/পিআর
Advertisement