জাগো জবস

সফলতার সিঁড়িগুলো অনেক কঠিন : সোয়েব কবীর

পুরো নাম সোয়েব কবীর। বাসার সবাই সোহেল বলেই ডাকে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ২০০৩ সালে এসএসসি ও ২০০৫ সালে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রামের সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তবে তা শেষ না করেই ২০০৮ সালে ব্রিটেনে চলে যান। সর্বশেষ ২০১২ সালে মাস্টার্স করেন কার্ডিফ মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে। এর মাঝে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ও জার্নালিজমের ওপর বেশ কয়েকটি কোর্স করেছেন। ব্রিটেনে বাংলা মিডিয়ার সর্বকনিষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে বিশেষ অবদানের জন্য ২৫ বছর বয়সেই সোয়েব কবীর পান টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল সিভিক অ্যাওয়ার্ড। সোয়েব কবীরের ক্যারিয়ারের নানা বিষয় নিয়ে জাগো জবসের পক্ষ থেকে কথা বলেছেন গোলাম রাব্বী।জাগো জবস : নিজের পড়াশোনার সঙ্গে আজকের পেশার যোগসূত্র স্থাপন করলেন কীভাবে?সোয়েব কবীর : এসএসসি পাস করার পর পরই হঠাৎ করে মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে মঞ্চ নাটক করতাম। একদিন নাটকের টিকিট দেয়ার জন্য দৈনিক আজাদীর বিভাগীয় সম্পাদক প্রদীপ দেওয়ানজীর কাছে যাই। তিনি অফিসের রিসিপশনে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। সেই অপেক্ষার মুহূর্তে পুরনো পত্রিকাগুলো পড়তে পড়তে স্কুলভিত্তিক একটি ফিচার নজরে আসে। অনেকক্ষণ পড়ার পর ভাবলাম- এমন রিপোর্ট তো আমিও করতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ। বিষয়টি প্রদীপ দেওয়ানজীকে দেখামাত্রই বললাম। তিনি বললেন, তোমার যেহেতু আগ্রহ আছে তুমি তোমার স্কুলের ওপর একটি রিপোর্ট করে নিয়ে আসো। আমি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি। স্কুলের কৃষি বিজ্ঞান শিক্ষক জিয়া স্যারের সহযোগিতায় রিপোর্টটি করে আজাদীর তৎকালীন আরেক বিভাগীয় সম্পাদক প্রবীর বড়ুয়ার কাছে জমা দিই। এরপর অপেক্ষা করতেই থাকি। সপ্তাহ তিনেক পরই আজাদীর ফিচার পাতার অর্ধপৃষ্ঠা জুড়েই আমার স্কুলের প্রতিবেদনটি আসে। সেই থেকেই শুরু, আর পিছনে ফিরে তাকাইনি।জাগো জবস : মিডিয়া ছাড়া অন্য কোনো পেশায় যুক্ত ছিলেন?সোয়েব কবীর : মিডিয়াতেই এসেছি একেবারে ছোট বয়সে। সে সময়ে মূলত চাকরি করার বয়স হয়নি। দেশেও মিডিয়া ছাড়া অন্য কিছুর সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না এবং ব্রিটেনেও পুরোদমেই মিডিয়া নিয়েই আছি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, লন্ডনে এসে মিডিয়া ছাড়া অন্য কোনো জব এখন পর্যন্ত করা হয়নি।জাগো জবস : অতীতের অভিজ্ঞতা বর্তমানে পৌঁছতে কতটুকু সাহায্য করেছে? সোয়েব কবীর : বেশি আগের কথা নয়। এক যুগ মাত্র। আর এই সময়ের মধ্যেই দেশের মিডিয়া অঙ্গনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগে আমরা কাগজে হাতে লিখে ফিচারগুলো জমা দিতাম। মূলত আমার সাংবাদিকতার শুরু থেকেই আমি চেয়েছিলাম একটি পত্রিকার সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা, ডিজাইন থেকে শুরু করে সার্কুলেশন, বিজ্ঞাপনসহ প্রিন্টিং সব কিছু সম্পর্কে ধারণা নিতে। আগে আমরা সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাপানোর সময় রাতভর প্রিন্টিং প্রেসে বসে থাকতে হতো। কালার কম্বিনেশন কিংবা পৃষ্ঠাগুলো সঠিকভাবে একের পর এক ছাপা হচ্ছে কিনা- এমন নানা খুঁতখুঁতে বিষয়গুলো যাতে কোনো ভুল না হয় সেদিকে সবসময়ই সতর্ক থাকতাম। বর্তমানে লন্ডনে এসে সেই অভিজ্ঞতার ষোলআনাই কাজে লেগেছে। ২০১০ সালে লন্ডনে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বাংলা নিউজ। সে সময়ে এই পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন ও ডিজাইনের ক্ষেত্রে নতুন একটি ধারার সৃষ্টি করেছিল।জাগো জবস : একটু যদি অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিয়ে আপনার শুরুর সময়কার স্মৃতিচারণ করতেন-সোয়েব কবীর : অনলাইন সংবাদমাধ্যমের গোড়াপত্তন ও বিপ্লবটা হয়েছিল বিডিনিউজ২৪ ডটকমের মাধ্যমে। আমি লন্ডন আসার আগেই চট্টগ্রামভিত্তিক একটি অনলাইন করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম; তবে আর্থিক সামর্থ্য ও আইটি অভিজ্ঞতা না থাকায় সে সময়ে সফল হতে পারিনি। এরপর তো লন্ডন চলে আসা হলো। তবে আমার অনলাইন নিউজ পোর্টালের স্বপ্নটা নিজের মনের মধ্যে ছিল। ওয়েবসাইট কীভাবে করতে হবে কিছুই জানতাম না। আস্তে আস্তে আমার রুমমেট মাহবুব জুয়েলের সহযোগিতায় ওয়েবসাইট করার প্রাথমিক প্রক্রিয়া শিখে নিয়েছিলাম। লন্ডনে প্রথম যখন এসেছিলাম তখন কোনো ডেভিট কার্ডও ছিলো না যে ডোমেইন কিনবো। তখন আমার সহকর্মী হেফাজুল করিম রাকিবকে বললাম একটি ডোমেইন কিনে দিতে। তিনিই ১০ পাউন্ড দিয়ে ইউকেবিডিনিউজ ডটকম ডোমেইনটি কিনে দিয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু ইউকেবিডিনিউজের পথচলা। এখনো অব্যাহত আছে। তবে আগের মতো এতোটা সক্রিয় না। তার অন্যতম কারণ হলো এখন একটি ল্যাপটপ নিয়েই অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদক হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। আমরা যখন অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিয়ে কাজ করেছি, তখন চিন্তাও করতে পারিনি যে এই উল্টোরথে চলবে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো। তবে এখন সরকারি নীতিমালার সিদ্ধান্তটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে অনলাইন মিডিয়ার ওপর পাঠকদের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে।জাগো জবস : কার অনুপ্রেরণায় আপনি মিডিয়াকে ভালোবেসে ফেললেন?সোয়েব কবীর : আসলে অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দুটোই পেয়েছি অনেকের কাছে। চট্টগ্রামেই আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। সেখানে দৈনিক আজাদীর বিভাগীয় সম্পাদক নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী ও প্রবীর বড়ুয়া- এই দু’জনেরই অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি পেয়েছি। তবে লেখালেখির জগতে আসাটা আমার বাবা মেনে নেননি প্রথমে। তবে মা সবসময়ই আমার পক্ষেই ছিলেন।জাগো জবস : এখন লন্ডনে অবস্থান করে ইউরোপের শরণার্থী নিয়ে কাজ করে অনেক আলোচিত হয়েছেন, বিষয়গুলো নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা যদি বলতেন-সোয়েব কবীর : ইউরোপের প্রায় অনেক দেশেই যাওয়া হয়েছে নিউজ করার জন্য। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলো ইউরোপমুখী শরণার্থীদের নিয়ে সময় টিভিতে প্রচারিত রিপোর্টগুলো। সেদিন সম্ভবত শনিবার ছিলো। জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মারকেল শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথেই ব্রিটেন থেকে উড়াল দিয়েছিলাম জার্মানিতে। সে সময়ে প্রায়ই সপ্তাহজুড়ে জার্মানি, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া থেকে শুরু করে গ্রিসের প্রত্যন্ত দ্বীপাঞ্চলে গিয়েছিলাম শরণার্থীদের খবরগুলো দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য।জাগো জবস : তখনকার কোনো স্মরণীয় ঘটনা-সোয়েব কবীর : সিরিয়ান শরণার্থীদের ভিড়ে বাংলাদেশি অনেকেই রয়েছেন- এমন সংবাদের সত্যতার জন্য গ্রিসের রাজধানী থেকে প্রায়ই ৫০০ কিলোমিটার দূরে লেসবস দ্বীপ গিয়েছিলাম একাই। পুরোদিন সেখানে থাকার পরেও কোনো বাংলাদেশির সন্ধান না পেয়ে বেশ হতাশ হয়ে সাগর পাড়ের বেঞ্চেই বসেছিলাম অনেকক্ষণ। হঠাৎ করেই আমার বেঞ্চের ঠিক পেছন থেকে বাংলা শব্দ কানে আসলো। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি তিন বাংলাদেশি যুবক সাগর পাড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ আগে এই দ্বীপে এসেছে। সেই তিন যুবকের করুণ কাহিনী নিয়ে প্রতিবেদনটিও বেশ সাড়া ফেলেছিলো। ওই তিনজনের একজন এখনও মাঝে মাঝে আমাকে ফোন দিয়ে খোঁজ-খবর নেয়।জাগো জবস : দেশে কিংবা প্রবাসে সাংবাদিকতার মিল-অমিল, ভালো-মন্দ নিয়ে যদি বলতেন-সোয়েব কবীর : দেশে সাংবাদিকতার ব্যাপ্তিটা অনেক বিশাল, তবে প্রবাসে এ গণ্ডিটা একেবারে ছোট। সময় যতই যাচ্ছে তা আরো সংকুচিত হচ্ছে। কারণ তৃতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশিরা বাংলা মিডিয়ার ওপর আগ্রহী নন। দেশে সাংবাদিকতার নামে নানা ধরনের অপসাংবাদিকতা হয়ে থাকে। এটিও এক ধরনের অপরাধ বলে আমি মনে করি। তবে দেশে এই অপরাধের সাজা হয়তো তেমন কেউই পান না। আর এর পুরো ভিন্ন চিত্র প্রবাসে- মিথ্যা, বানোয়াট কিংবা পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করলে যে কেউ-ই আদালতের সম্মুখীন হতে পারেন। প্রবাসী সাংবাদিকরা দেশের সাংবাদিকদের নিয়ে ভাবেন, কথা বলেন, কিন্তু আমার মনে হয় দেশের সাংবাদিকরা প্রবাসী সাংবাদিকদের নিয়ে ঠিক তেমন ভাবেন না কিংবা মূল্যায়ন করেন না।জাগো জবস : এখন রিপোর্টিং ছাড়া আপনাকে আর কী কী করতে হয়?সোয়েব কবীর : প্রবাসে সব কিছুই সীমিত। বাংলাদেশে যেখানে একটি টিভি স্টেশন চালাতে জনবল প্রয়োজন হয় প্রায় শতাধিক, সেখানে প্রবাসে হাতেগোনা কয়েকজন দিয়েই দিব্যি ২৪ ঘণ্টার টিভি চ্যানেল চালিয়ে যাচ্ছে। দক্ষ জনবল সংকটও এটার অন্যতম কারণ। রিপোর্টিংয়ে প্রয়োজনে ক্যামেরা চালানো থেকে শুরু করে ভিডিও এডিটিংসহ অনেক কাজই করতে হয় সবসময়।জাগো জবস : প্রবাস জীবনেও আপনি সাংবাদিকতা করছেন, পেশা হিসেবে এটা কেমন?সোয়েব কবীর : প্রবাসে এসে শুরুতেই সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়াটাই বোকামি বলে আমি মনে করি। প্রথমেই অন্য একটি চাকরি কিংবা আয়ের উৎস সৃষ্টির পাশাপাশি সাংবাদিকতার চর্চা করা যায়। এরপর সময় বুঝে পুরোদমে প্রবাসে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়াটাই ভালো।জাগো জবস : কেউ বিদেশে বসে সাংবাদিকতা করতে চাইলে, তারা কী করতে পারেন?সোয়েব কবীর : যোগ্যতা থাকলে যে কেউ মফস্বল হোক কিংবা গ্লোবালি হোক- সাংবাদিকতা করতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে ধৈর্য, সততা ও মেধাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রবাসে সাংবাদিকতা করা একদিকে যেমন অনেক সহজ, ঠিক তেমনই নানা নিয়মনীতির কারণে অনেক কঠিন হয়ে ওঠে।জাগো জবস : আপনার প্রফেশনে আয় ও সুযোগ-সুবিধা কেমন?সোয়েব কবীর : আগে তো বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রবাস প্রতিনিধি মানেই ফ্রি কাজ করে যাওয়া। তবে এখন প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিনিধিদের ভালো বেতন দিচ্ছে। পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধা তো থাকছেই। তবে এটা এখন ভালো হয়েছে যে, প্রবাসী সংবাদদাতা মানেই যে ফ্রি কাজ করবেন- এই ধারণা উঠে গেছে।জাগো জবস : সফলতা বলতে আপনি কী বোঝেন?সোয়েব কবীর : সফলতা বলতে বুঝি, আমি যা করতে চেয়েছি তা শতভাগ করতে পারা। তবে সফলতার সিঁড়িগুলো কখনো কখনো অনেক কঠিন হয়। এসব পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে পারলেই সফলতা ধরা দেবে।জাগো জবস : মিডিয়া নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একটু বলবেন কি?সোয়েব কবীর : ইচ্ছা আছে প্রবাসের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে নতুন ধারার সংবাদমাধ্যম গড়ে তোলার। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য মানসম্মত ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আছে এবং সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।এসইউ

Advertisement