যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে নির্যাতন এমনকি হত্যাকাণ্ডের খবরও আমরা পেয়ে থাকি বিভিন্ন সময়। দৈনিক পত্রিকা এবং নিউজ পোর্টালগুলোতে চোখ বুলালেই প্রতিদিন এ ধরনের কোনো না কোনো সংবাদ পাওয়া যাবে। এই সংবাদগুলো আমাদের জন্য সুখকর নয়। বিশেষ করে আমরা যারা নারী, তাদের মনের উপর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এ ধরনের সংবাদ । আমাদের মনে হতে থাকে, আমরা বুঝি অসহায় ও অসংগঠিত। আমরা বুঝি আমাদের বোনের পাশে, মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারি না। আমাদের পায়ে বুঝি এক অদৃশ্য শেকল পরানো। পায়ের শেকলটি আসেল লোহার তৈরি নয়। এটি তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিনের মানসিক দাসত্বের চর্চা থেকে। বেগম রোকেয়া পরবর্তী সময়ে আমরা মেয়েরা যে খুব একটা আধুনিক হয়েছি, তা কিন্তু বলা যায় না। ঝকমকে সাজ-পোশাক, দামী পারফিউমের ঘ্রাণ নারীকে বাহ্যিকভাবে আধুনিক হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেয় ঠিকই, তবে এতে মানসিক মুক্তি মেলে না। আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকেই একটি মেয়েকে বড় করা হয় এই ভেবে যে, তার একটি ভালো বিয়ে হবে। হ্যাঁ, কিছু চিত্র হয়তো বদলেছে। তবে তা এতটাই কম যে প্রায় চোখে পড়েই না বলতে গেলে। বেশিরভাগ মেয়েকেই পরোক্ষভাবে বোঝানো হয়, বড় হলে তার একটা ভালো বিয়ে হবে। এবং তার জন্যই তাকে তৈরি করা হয়। মেয়েটি আর কী করে। পড়াশোনা কিংবা ক্যারিয়ারের দিকে মন না দিয়ে সাজ-পোশাক আর সৌন্দর্যচর্চায় মনোনিবেশ করে। যদিওবা সে পড়াশোনা করে, তাও কিন্তু ভালো একটি বর পাবে, সেই প্রত্যাশায়। একটি ছেলেকে বুঝতে শেখার পরপরই শুনতে হয়, বড় হয়ে তাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। মা-বাবার বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন, বংশের প্রদীপ ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ এই কথাগুলোই যদি একটি মেয়েকে বোঝানো হয় তবে তার চিন্তাধারা আমূল বদলে যাবে। একটি মেয়েকে যদি শিশু বয়স থেকেই স্বনির্ভরতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়, তবে সে সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাবে। বিয়ে একটি সামাজিক রীতি। এটি যথাসময়ে হবে এবং তার জন্য আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখে মূল্যবান সময়গুলো যে নষ্ট করা উচিৎ নয়, এই শিক্ষা আমাদের মা-বাবারা মেয়েদেরকে দেন না। যার কারণে শিশুবয়সে একটি ছেলে যখন খেলনা গাড়ি ভেঙে তা আবার জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে, মেয়েরা তখন পুতুল বিয়ে নিয়ে দিন কাটায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিয়ে দেয়া হয় মেয়ের অমতে। মুসলিম প্রধান এদেশে এ কেমন বেমানান রীতি! যেখানে ইসলাম ধর্মের রীতি অনুসারে মেয়ের মত না থাকলে বিয়েই হয় না! শহরের চিত্র কিছুটা পাল্টালেও, পাল্টায়নি গ্রাম কিংবা মফস্বল এলাকাগুলোর চিত্র। সেখানে মেয়ের মতামত গ্রাহ্যই করা হয় না। বরং মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হতে না হতেই বিয়ে নামক রীতির মাধ্যমে তুলে দেয়া হয় আরেক পরিবারের কাছে। এবং মেয়েটির নিজস্ব অবস্থান তখন এতটাই নাজুক থাকে যে নিজের পক্ষে দুটি কথা বলারও সুযোগ থাকে না তার। আমরা জানি, যৌতুক দেয়া এবং নেয়া সমান অপরাধ। অথচ আজ পর্যন্ত যৌতুক দেয়ার অপরাধে কোনো কন্যার বাবাকে আটক কিংবা গ্রেফতার হতে দেখলাম না। (নেয়ার অপরাধেও জেল-জরিমানার পরিমাণও কম)। আইনের এই দ্বিমুখী আচরণ যৌতুকপ্রথা প্রচলনের অন্যতম কারণ। মেয়েকে `সুখী` রাখতে যে পরিমাণ যৌতুক দেয়া হয়, সেই টাকায় মেয়েটিকে স্বনির্ভর করে তুললে মেয়েটি তো এমনিতেই সুখী হতে পারে। যৌতুক না দিলে যে ছেলেটি নির্যাতনের হুমকি দিতে পারে, যৌতুক দেয়ার পরে সেই ছেলেটি তার স্ত্রীকে কতটুকু ভালো রাখবে, তা তো সহজেই অনুমেয়। মেয়ের পরিবার এবং ছেলের পরিবারের এই দরকষাকষির মধ্যে পড়ে পিষ্ট হয়ে যায় মেয়েটির জীবন। সে জানতেও পারে না, তার অপরাধটা আসলে কী? কেন তাকে অন্যের মন জোগানোর কাজেই একটি পূর্ণ জীবন পার করে দিতে হয়! সময় এসেছে আমাদের মা-বাবাদের মানবিক ও বাস্তবমুখি হওয়ার, মেয়েকে মেয়ে এবং ছেলেকে ছেলে হিসেবে বড় না করে মানবিক শিক্ষা দিয়ে মানুষ করে গড়ে তোলার। একটি মেয়েকে যোগ্য করে গড়ে তুললে সেও তো হতে পারে বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন। নিজের সন্তানকে যেন এমনভাবে গড়ে তুলতে না হয়, যাতে সেই সন্তানটিকেই বড় হয়ে আরেকজনের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হয়, হোক তা যৌতুকের জন্য বা জীবনধারণের জন্য। ছেলে কিংবা মেয়ে, স্বনির্ভর মানুষ হিসেবে গড়ে তুললে যৌতুক নামক কুসংস্কার আর আমাদের গ্রাস করতে পারবে না।লেখক : কবি, সাংবাদিকএইচআর/এমএস
Advertisement