ড. আকবর আলি খান। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজ গবেষক। সাবেক আমলা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। শিক্ষকতা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সমাজ, রাজনীতি, গণতন্ত্র, সুশাসন নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। গণতন্ত্র এবং সুশাসনের অভাবেই দেশে উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটছে বলে মত দেন। সঙ্কট উত্তরণে জনভাবনাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান এই বিশ্লেষক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। আজ থাকছে প্রথম পর্ব। জাগো নিউজ : গুলশান ট্র্যাজেডির ক্ষত এখনো দগদগে। বিশ্ব শোকে মুহ্যমান। এমন ঘটনা ঘটতে পারে এমনটি কি ধারণা করেছিলাম অথবা এর জন্য কতটুকু প্রস্তুত ছিলাম আমরা? ড. আকবর আলি খান : গুলশান হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ নিয়ে আমাদের যে প্রাচীন ধারণা ছিল তাতে আমরা মনে করেছিলাম হয়ত এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটবে না। এতদিন মনে করা হতো জঙ্গিবাদের সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার যোগ রয়েছে। ইসলামী দলগুলো মাদরাসা শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত অথবা এই দলগুলো মাদরাসা শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে যেখান থেকে মৌলবাদের উৎপত্তি। কিন্তু ধারণা পাল্টেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে আধুনিক শিক্ষিতরাও মৌলবাদে ধারণা পোষণ করছে এবং অনেকাংশে তারাই সফল। জাগো নিউজ : এই যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা মৌলবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে, এর কারণ কি বলে মনে করেন? ড. আকবর আলি খান : বিশ্বায়নের প্রভাব। এটা অনেকেই হজম করতে বা এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না এবং এটি দৃশ্যমানও বটে। ইইউ থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে গেল। সেখানে পার্লামেন্ট সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হল। মধ্যপ্রাচ্যের নানা হিসাব এখন সবাই কষছে। আসলে মৌলবাদীর বহুরূপ রয়েছে। আপনি শুধু মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার দোষ দিয়েই দায় এড়াতে পারেন না। আর এ কারণেই জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি রয়েছে। একইভাবে গুলশানের মতো ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে ক্ষুণ্ন হতে পারে, তা মোকাবেলার জন্যও আমাদের প্রস্তুতি ছিল না।জাগো নিউজ : এখানে তাৎক্ষণিক এবং সামগ্রিক এ দুই ধরনের প্রস্তুতির বিষয় আসে। সামগ্রিক প্রস্তুতিতে সমাজ, রাজনীতি, শাসন কাঠামো গুরুত্ব পায়। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? ড. আকবর আলি খান : সমাজ, রাজনীতি দ্বারাই তো সব নিয়ন্ত্রিত। এমন বিষয় মোকাবেলায় সবার আগে সামাজিক চিন্তাধারাকে গুরুত্ব দিতে হয়। সমাজ, রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদের বিষয়ে ভুল ধারণা রয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ মনে করে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের ধর্মকর্ম পালনের সমাধিকার নিশ্চিত হলেই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা পেল। ইসলাম ধর্মেও এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। ভিন্নধর্মীদের স্বাধীনতা ইসলামও সংরক্ষণ করে। সমস্যা হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে। মুসলমানরা মনে করে ইসলামের মতবাদে কোনো তফাৎ নেই। যারা মতভেদ সৃষ্টি করে তারা কাফের এবং তাদের হত্যা করা ওয়াজিব। সমস্যা হচ্ছে এখানেই। তার মানে অন্য ধর্মের মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া যত সহজ, তার চেয়ে অনেক কঠিন নিজ ধর্মের ভিন্ন মতাবলম্বীদের স্বাধীনতা দেয়া। ষোড়শ শতকে ইউরোপে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এই সমস্যা ছিল। প্রায় ৩০ বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর তারা চুক্তি করে বলল যে, নিজ ধর্মের মধ্যেও ভিন্ন মত থাকতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে আজ পর্যন্ত কোনো মুসলমান মনে করে না যে অন্য মুসলমানের ভিন্ন মত থাকতে পারে। জাগো নিউজ : এই সমস্যা ইসলামের নাকি মুসলমানদের তৈরি করা? ড. আকবর আলি খান : মুসলমানদের তৈরি। একমাত্র ইরান ছাড়া আর কোনো ভিন্ন মতাবলম্বী রাষ্ট্র নেই। বাকি ইসলামী দেশগুলোতে সুন্নি-শিয়া, সুন্নি-আহমাদিয়া যুদ্ধ চলছেই। আবার সুন্নিদের মধ্যেই একাধিক মত রয়েছে এবং তারা একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। ইসলাম ধর্মের এই বিষয়টি সমাধান করতে হবে। জাগো নিউজ : এটি তো অনেকটাই মৌলিক সমস্যা। চাইলেই কি সমাধান সম্ভব? ড. আকবর আলি খান : আমি উদ্বিগ্ন এখানেই। এগুলো নিয়ে আমাদের মাঝে কোনো আলোচনা নেই। এখানে শুধু আলোচনা হয় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের অধিকার নিয়ে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে যারা ভিন্ন মত পোষণ করেন, তাদের অধিকার কীভাবে রক্ষা করা হবে, সে ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয় না। আধুনিক যুগে ধর্মান্ধতা দূর করার সহজ উপায় হল আলাপ-আলোচনা এবং একে অপরের প্রতি সহনশীলতা প্রকাশ করা। কিন্তু এখানে তা না করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা দিতে সর্বশক্তি প্রকাশ করে।জাগো নিউজ : অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি। এখানে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে প্রমাণ মিলছে। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি? ড. আকবর আলি খান : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে একেবারেই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বেসরকারি শিক্ষায় শুধু চাকরির ওপরই জোর দেয়া হয়। এখানে মানসিক বিকাশের কোনো আলোচনা নেই। শিক্ষার্থীরা কয়েক ঘণ্টার জন্য ক্যাম্পাসে এসেই চলে যায়। এ কারণেই এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অন্ধকারে পা রাখার সুযোগ পায়। এর জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা দায়ী। সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবেই উচ্চশিক্ষতরা জঙ্গিবাদে পা রাখছে।জাগো নিউজ : এই মুহূর্তে উপায় কি? ড. আকবর আলি খান : যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত। প্রথমত এসব গোষ্ঠীর উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, এদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। যে কোনো ঘটনা মোকাবেলায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব ঘটনায় যত বেশি সময় দেয়া হবে, তারা ততো বেশি প্রচার পাবে। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমেরও সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, তাদের কর্মকাণ্ড ফলাও করে প্রচার হলে তারা উৎসাহিত হয়। জাগো নিউজ : মাদরাসার বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অভিযোগ পুরনো। এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যদি উচ্চশিক্ষিতদের সংযোগ ঘটে তাহলে পরিস্থিতি কি হতে পারে বলে মনে করেন? ড. আকবর আলি খান : এ নিয়ে আমি শঙ্কিত নই। কারণ যারা জঙ্গি হামলা করছে তারা অত্যন্ত ছোট দলের। কমিউনিস্ট পার্টির যেমন তৃণমূলের সঙ্গে উপরের সংযোগ থাকে এদের তা নেই। যে কারণে সমর্থন পাওয়া তাদের জন্য অনেক কঠিন। এছাড়া এরা কোনো বড় দলে রূপ নিলেই ধর্মের প্রশ্নে বিভাজন হয়ে যাবে। জাগো নিউজ : যদি কোনো বড় রাজনৈতিক দল এদের সংগঠিত করে? ড. আকবর আলি খান : সাধারণত ইসলামী দলগুলোই এটি করতে পারে। কিন্তু দেখবেন ধর্মের প্রশ্নে ইসলামী দলগুলোর কত ফারাক? এরা নিজেরাই কোনোদিন ইসলাম প্রশ্নে এক হতে পারেনি। মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে এরা রাজনীতি করেন ঠিক, কিন্তু অনেক পার্থক্য রেখে। এরা কখনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেলে দেখা যাবে তাদের মধ্যেই নানা ভাগ হয়েছে। তবে মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন জরুরি। মাদরাসা শিক্ষার দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই মাদরাসার শিক্ষির্থীরা সমাজ, দেশ ও অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। আমি শঙ্কিত ইসলাম ধর্মের যারা ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন তাদের সহ্য করা হবে কি হবে না, তা নিয়ে। জাগো নিউজ : এই শঙ্কা কি রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে? ড. আকবর আলি খান : ধর্ম প্রশ্নে আমি রাষ্ট্রকে টানতে চাই না। এর জন্য সমাজের সুশীল এবং বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন।জাগো নিউজ : এ ক্ষেত্রে তো সুশীল বা বুদ্ধিজীবীরাও ব্যর্থ? ড. আকবর আলি খান : অবশ্যই সুশীল সমাজের ব্যর্থতা রয়েছে। আর এ কারণেই তো সমাজ প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা। জাগো নিউজ : সমাজব্যবস্থা ঠিক করার কথা বলছেন? কিন্তু আইএস বা আল কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক সংগঠন সমাজ, নীতিকে তোয়াক্কা করে? ড. আকবর আলি খান : দেখুন, আইএস বাংলাদেশে খুব সুবিধা করতে পারবে না। কারণ সিরিয়া, ইরাক বা আফগানিস্তানে আইএস বা আল কায়েদা ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে যেভাবে ভিত গেড়েছে, সেটা বাংলাদেশে সম্ভব নয়। সেখানকার যুদ্ধাবস্থাই ভিত তৈরির সুযোগ করেছে। সেখানে অনেকেই আইএসে যোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশে এটি হবে না। জাগো নিউজ : বাংলাদেশে হবে না, কেন এমনটি মনে করছেন? ড. আকবর আলি খান : ইরাক এবং সিরিয়া ব্যর্থ রাষ্ট্র। এদের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো তুলনা হয় না। বাংলাদেশ যদি কখনো ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় আর এ দেশের মানুষ যদি বিদেশি কোনো শক্তির সঙ্গে লড়াই করে, তাহলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তবে চলমান রাজনীতি নিয়ে চরম উদ্বেগ রয়েছে। আমরা বারবার বলছি, বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা জরুরি। অন্যের মত সহ্য করা হচ্ছে না। অন্যের মত যদি সহ্য করা না হয়, তাহলে রাষ্ট্র, সমাজ সবই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এএসএস/এএইচ/এসএইচএস/আরআইপি/এমএফ
Advertisement