বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশে আল কায়েদা থেকে এগিয়ে আইএস

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক। সাবেক নির্বাচন কমিশনার। লিখছেন দেশের নিরাপত্তা, রাজনীতি এবং সমাজের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। গুলশান ট্র্যাজেডির প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজের মুখোমুখি হন তিনি। বলেন, এমনটি হতে পারে সে শঙ্কা আমরা বহু আগে থেকেই প্রকাশ করে আসছিলাম। এর দায় সমাজের সবার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

Advertisement

জাগো নিউজ : এর আগে জাগো নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তাই ঘটল গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে। যে ঘটনায় স্তম্ভিত গোটা জাতি, গোটা বিশ্ব। এখন কি বলবেন? সাখাওয়াত হোসেন : এমন ঘটনা ঘটবে, তা অনুমান করা যাচ্ছিল। আমরা অনেকেই এমন শঙ্কার ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলাম। আমরা মূলত সরকারকে সহযোগিতা করার জন্যই এই বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোকপাত করেছি।   দেশে বেশ কিছু টার্গেট হত্যাকাণ্ড ঘটল। এগুলো ছিল টিপ অব দ্য আইসবার্ক বা হিমশৈলের দৃশ্যমান অংশ। আপনি হিমশৈলের উপরের অংশ দেখতে পাবেন। কিন্তু নিচের গভীরতার ধারণা করতে পারবেন না। টাইটানিক জাহাজ হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে গেছে। নাবিকের ওই হিমশৈল সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে।মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গতি রেখে আপনাকে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আপনি জঙ্গি তথা বিশেষ করে আইএসের শক্তি নানাভাবেই নিরীক্ষা করতে পারেন। তিরকিতে যখন আইএস ক্যান্টনমেন্ট দখল করল, তখন ক্যান্টনমেন্টের সকল সেনা অস্ত্র রেখে পালিয়ে গেল। আইএস সদস্যরা ট্যাংক, কামান নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। এরা কারা? তারা কীভাবে ট্যাংক চালানো শিখল? তার মানে আইএস সদস্যরা আগেই অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা তাদের আগে থেকেই ছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এখন এই শক্তির বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করতে হবে। জাগো নিউজ : কিন্তু বাইরে থেকে উচ্চশিক্ষিতরাও তো ইরাক-সিরিয়ার আইএসে যোগ দিচ্ছে? সাখাওয়াত হোসেন : এই যোগ দেয়ার নানা কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে আইএসের শক্তির প্রকাশ। আইএসের শক্তি দেখে অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছে। আইএসে যোগ দিয়ে তারা ভরসা পাচ্ছে। আইএস সরকার গঠন করলো। তাদের নিজস্ব বিধান আছে। আইএসের সদস্যদের বেতন দেয়া হয়। আইএসের কাছ থেকে কালোবাজারের মাধ্যমে অনেক দেশ তেল ক্রয় করে। ইসরায়েল, তুরস্ক, জর্ডান, ইরান স্বল্প দামে আইএসের কাছ থেকে তেল কিনে লাভবান হচ্ছে। অর্থের সংস্থান করতে পেরেই আইএস এবং আল কায়েদায় সদস্য অন্তর্ভুক্তির ধরন পাল্টিয়েছে। তারা আর মাদ্রাসায় পড়ুয়া লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকা ছাত্রদের দলে ভেড়াতে চায় না। যদিও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও যাচ্ছে। তবে তারাও উচ্চশিক্ষিত। মাদ্রাসা বা কওমির কম পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে তারা দল ভারি করতে চাইছে না। আইএসে এখন তিন ধরনের নিয়োগ রয়েছে। সম্মুখভাগের যোদ্ধা, গেরিলা যোদ্ধা ও প্রযুক্তিবিদ। এই তিন ধরনের জনশক্তি পেয়ে আইএস ভিন্ন রূপে হাজির হয়েছে। এটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর কাছে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে। আইএস অনেকটাই ফুকোইজম নীতি অবলম্বন করে কাজ করছে। আর আল কায়েদা কাজ করছে মাওবাদীদের নীতি অনুসরণ করে। জাগো নিউজ : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন নীতি গুরুত্ব পাচ্ছে? সাখাওয়াত হোসেন : উভয় নীতিই গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশে। মূলত জঙ্গি উত্থান নিয়ে বাংলাদেশে গভীর কোনো বিশ্লেষণ নেই। খুব দুর্বল আলোচনা হয় এখানে। কিন্তু হামলাগুলোর ব্যাপারে জঙ্গিদের নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। আইএস যে হামলার কথা স্বীকার করছে, সেটি আল কায়েদা বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম স্বীকার করেনি। আবার আল কায়েদার হামলার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন পুরোহিত হত্যাকাণ্ড নিয়েও নির্দিষ্ট বক্তব্য দিয়েছে। গুলিয়ে ফেলছে আমাদের প্রশাসন, মিডিয়া ও সমাজ। যে যার মতো করে বিশ্লেষণ করে মনগড়া ব্যাখ্যা দিচ্ছে।২০১৪ সালের ২৯ জুন খেলাফত ঘোষণা দিল আল-বাগদাদী। গেল ২৮ জুন তিরকিতে হামলা করলো। ঢাকার গুলশানে হামলা হলো ১ জুলাই। বাগদাদে হামলা হল ২ জুলাই। এরপর মদিনায়। তার মানে কয়েকটি মারাত্মক হামলার ঘটনা ঘটে ২৯ জুলাইয়ের আশপাশের তারিখে। অর্থাৎ খেলাফত ঘোষণার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তারা এই হামলাগুলো পরিচালনা করে। প্রচার রয়েছে বাংলাদেশে হামলার ঘটনা তারা আগে থেকেই বলে আসছিল। আইএস ফুকোইজম নীতি অবলম্বন করে হামলা পরিচালনা করে সরকারকে টালমাটাল করে দিতে চাইছে। অনেকের সন্তানই নিখোঁজ রয়েছে। পুলিশের কাছেও কোনো তথ্য নেই। পুলিশ খোঁজ দিচ্ছে যার, সে আবার পুলিশেরই হেফাজতে থাকা অবস্থায় ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছে। কোনো সঠিক তথ্য নেই কারো কাছে। যে পাঁচ জঙ্গির কথা প্রকাশ পেল, তাদের জন্যও তো বড় দুঃখ লাগল। এভাবে একজন মানুষ তার জীবনকে বিপথগামী করে তুলতে পারে! কেন যেন মনে হচ্ছে, সমাজের সবাই মিলে তাদের এ পথে ঠেলে দিচ্ছি। জাগো নিউজ : এমন হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আসলে কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায়? সাখাওয়াত হোসেন : এটি কোনো মতবাদ নয়, এটি হচ্ছে কৌশল। জঙ্গিরা মনে করে সাধারণরা যে ইসলাম ধারণ করে আছে তা ভুল এবং পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া ইসলাম। এটি পরিবর্তন করার জন্যই তাদের এই কৌশল। তারা মনে করছে খোলাফায়ে রাশেদিনের পন্থা ছাড়া সত্যিকার ইসলাম সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আইএস এবং আল কায়েদা উভয়ই তাই মনে করে। তবে কৌশল আলাদা। আল কায়েদা মনে করছে আইএস ধ্বংস হলেই তারা সফল হবে। আবার আইএস মনে করছে নর্থ আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত হামলার মধ্য দিয়েই শক্তির জানান দিতে হবে এবং এভাবেই একদিন সফলতা আসবে। জাগো নিউজ : এই কৌশল তো দীর্ঘমেয়াদি? সাখাওয়াত হোসেন : আল কায়েদার পরিকল্পনা আইএসের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই তা বিশ্লেষণ করা যায়। বাংলাদেশে ৩৮টি হামলার ঘটনায় আল কায়েদা ৭/৮টির দায় স্বীকার করেছে। বাকিগুলো আইএস স্বীকার করেছে। আইএস ও আল কায়েদার কাজ একই, তবে কৌশল ভিন্ন।জাগো নিউজ : বাংলাদেশে এগিয়ে কারা? সাখাওয়াত হোসেন : অবশ্যই বাংলাদেশে আল কায়েদা থেকে আইএস এগিয়ে। তারা যে কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে যে পরিমাণ তাৎক্ষণিক ফলাফল এবং প্রচার পায়, তা আল কায়েদা পাচ্ছে না। আল কায়েদার আগের মতো ফান্ডও নেই। যারা আল কায়েদাকে ফান্ড দিত তারাই এখন আইএসকে ফান্ড দিচ্ছে।মধ্যপ্রাচ্যের অনেক ব্যবসায়ীই আইএসকে স্বেচ্ছায় অর্থ দিচ্ছে। তারা বলছে, ‘তুমি চাঁদা নাও, তবে আমার প্রতিষ্ঠানে হামলা করো না।’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই ঘটতে পারে। অস্বাভাবিক কিছুই না।জাগো নিউজ : আপনি উচ্চশিক্ষিতদের কথা বলছেন। কিন্তু জঙ্গি ইস্যুতে প্রশাসন জেএমবিকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে? সাখাওয়াত হোসেন : সমস্যা তো এখানেই। জঙ্গিদের এখন যারা মারা যাচ্ছে বা ধরা পড়ছে, তারা কিন্তু মাদ্রাসার ছাত্র নয়। সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং নামি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। আমি শুধু প্রেক্ষাপট এবং তা পরিবর্তনের কথা বলছি।গোয়েন্দারা এখনও পুরনো লিস্ট নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, আর সরকার বলছেন দেশীয় জঙ্গি। অবশ্যই দেশি জঙ্গি। তাতে কি হামলার ভয়াবহতা কমছে? আইএস কি ইরাক থেকে জঙ্গি পাঠিয়ে হামলা করবে? তারা তো এদেশের লোক দিয়েই হামলা করবে এবং ভয়ের কথা তো এখানেই। দেশি জঙ্গি করছে, বাংলাদেশে আইএস নেই, আল কায়েদা নেই এসব বলে তো শেষ রক্ষা হচ্ছে না। এখন জঙ্গিরা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মাদ্রাসায় নজর রাখতে গিয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের খবর রাখেননি কেউ।জাগো নিউজ : তাই বলে এমন পরিবেশের সঙ্গে জঙ্গি চিন্তাধারা মেলানো যায়? সাখাওয়াত হোসেন : দেখুন, এমন পরিবারের সন্তানরা অনেক দিকেই যেতে পারে। অনেকে ভালোও করছে। এদের অনেকেই দেখছে, সমাজের সর্বত্রই দুঃশাসন, দুর্নীতি ও বৈষম্য। তারা পৃথিবীটাকে বসবাসের অযোগ্য মনে করে। তখন নিজের একটি জগৎ তৈরি করতে চায়। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। আর এটিই হচ্ছে তার মানসিক ভারসাম্যহীনতা। একটি ১৮ বছরের ছেলের বন্ধুবান্ধব থাকবে। তেমনি একজন মেয়ের মনে রোমাঞ্চ থাকবে। এটি না থাকলেই সমস্যা। অভিভাবক, সমাজ মূলত এই সমস্যাটাই বুঝতে চেষ্টা করছে না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকা ছেলেটি যখন দেখছে সমুদ্র তীরে মুসলমান শিশু আয়লান ভেসে যাচ্ছে, তখন তার মধ্যে ভিন্ন চিন্তা আসা খুবই স্বাভাবিক। ঘরে বসে থাকলেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আইএস, আল কায়েদার বার্তা সব সময় পেয়ে যাচ্ছে। এসবের মধ্য দিয়ে একজন তরুণ যে কোনো পথেই পা রাখতে পারে। এএসএস/একে/এসএইচএস/আরআইপি