মতামত

অশান্তির উৎস পিস টিভি?

যেসব তরুণের দেশ বদলের নায়ক হওয়ার কথা, সেই মেধাবী তরুণরাই হয়ে যাচ্ছে খলনায়ক। আর বরাবর যাদের গালি দিয়ে আমরা আরাম পাই, সেই পুলিশ সদস্যরা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জীবন দিচ্ছে অকাতরে। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় চারজন পুলিশ সদস্য জীবন দিয়েছেন। এরাই আমাদের নায়ক, আমাদের সাহস জোগায়। এই নায়ক-খলনায়কের ভিড়ে আলোচনায় চলে এসেছেন আরেক নায়েক, ড. জাকির নায়েক। ভারতীয় এই ইসলামী চিন্তাবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তরুণদের বিভ্রান্ত করছেন। তার বক্তব্য শুনে অনেকে জঙ্গি পথে যেতে প্ররোচিত হয়েছে। সর্বশেষ গুলশানের ঘটনায় আবার আলোচনায় আসেন ড. জাকির নায়েক এবং তার পরিচালিত পিস টিভি। গুলশান হামলায় অংশ নেয়া অন্তত দুজন জঙ্গি ড. জাকির নায়েকের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়েছে, এমন তথ্য পত্রিকায় প্রকাশের পর শুরু হয় তোলপাড়।পেশায় চিকিৎসক হলেও ড. জাকির নায়েক ১৯৯১ সালে অলাভজনক ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইআরএফ) গঠন করে ইসলাম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। আইআরএফের অধীনে ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি দুবাই থেকে সম্প্রচার শুরু হয় পিস টিভির। অল্প সময়েই ইসলামী বিশ্বে দারুণ জনপ্রিয়তা পায় পিস টিভি। মূল পিস টিভি ইংরেজি ভাষায় সম্প্রচার চালালেও আঞ্চলিক ভাষাভাষী দর্শকদের কথা মাথায় রেখে ২০০৯ সালে সম্প্রচারে আসে পিসি টিভি উর্দু এবং ২০১১ সালে চালু হয় পিস টিভি বাংলা। গুলশান হামলাকারীরা ড. জাকির নায়েকের বক্তব্য শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছে, এটা প্রচারিত হওয়ার পর ভারত সরকার সে দেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। তদন্ত শুরু হয়েছে আইআরএফের আয়-ব্যয়, জাকির নায়েকের নানা তৎপরতা এবং তার বক্তৃতা নিয়েও। ভারতে পিস টিভি বন্ধের দিনই একই প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামালের কাছেও। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে পিস টিভি খুব জনপ্রিয়। তাই যথাযথ তদন্ত করেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশ সরকার একদিনও সময় নেয়নি। ৯ দিনের ঈদের ছুটি শেষে অফিস খোলার প্রথম দিনই আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটির সভায় বাংলাদেশে পিসি টিভির সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়ায়ও পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অনেক দেশেই অবাঞ্ছিত ড. জাকির নায়েক।তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, তা মিথ্যা নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয় পিস টিভি। কিন্তু জনপ্রিয় বলেই সেটা চলতে দেয়া উচিত নয়। সেটা দেশের জন্য, ইসলামের জন্য, মানবতার জন্য ক্ষতিকর কি না; তা আগে বিবেচনা করা উচিত। ইয়াবাও তো বাংলাদেশে জনপ্রিয়। তাই বলে কি ইয়াবা অবাধে বিক্রির অনুমতি দেয়া হবে? ড. জাকির নায়েক যদি সত্যি বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তরুণদের জঙ্গিপনায় প্ররোচিত করে থাকেন, তাহলে বলতেই হবে পিস টিভি মাদকের মতই ভয়াবহ। তার বক্তব্য মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। এই সুযোগে তিনি সুন্দর করে বিভ্রান্তি ছড়ান। ওসামা বিন লাদেনের পক্ষে তার অবস্থান ছিল পরিষ্কার, ‘যদি বিন লাদেন ইসলামের শত্রুদের সাথে লড়াই করে থাকেন, তবে আমিও তার সাথে আছি।’ ড. জাকির নায়েক আরো বলেছেন, ‘মুসলমানদের এমন হওয়া উচিত, যেন তাদের দেখলে সমাজবিরোধী লোকদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি হয় এবং এরূপ হলে প্রত্যেক মুসলমানকে একেকজন সন্ত্রাসী হওয়া দরকার।’ শুধু বাংলাদেশের জঙ্গিরা নয়, পুলিশের গুলিতে নিহত কাশ্মীরি জঙ্গিদের পোস্টার বয় বুরহান মুজাফফর ওয়ানীও জাকির নায়েকের অনুসারী ছিল। আমি কোনোদিন পিস টিভি দেখিনি। তাও এর ভালো-মন্দত্ব নিয়ে আমি রায় দিতে পারবো না। তবে জঙ্গিরা যার বক্তব্য শুনে প্ররোচিত হয়, যিনি লাদেনের পক্ষে অবস্থান নেন, যিনি মুসলমানদের সন্ত্রাসী হতে বলেন; তার বক্তব্য প্রচারের সুযোগ থাকা উচিত নয়। তবে কথা হলো, ১০ বছর ধরে পিস টিভি কীভাবে অশান্তি ছড়িয়ে আসছে। আগুন লাগানোর পর নেভানোর চেষ্টা করার চেয়ে, আগুন যাতে না লাগে, সে ব্যবস্থা করাই উত্তম।এটা ঠিক, এখন বিশ্বজুড়েই ইসলামকে হেয় করার ষড়যন্ত্র চলছে। ইসলামের নামেই চলছে এই ষড়যন্ত্র। ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিশ্বজুড়ে যে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে, তা কোনোভাবেই ইসলামের চেতনার সমান্তরাল নয়। আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল সাইট ইন্টেলিজেন্স চালান একজন ইহুদি নারী রিতা কাটজ। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের ছদ্মাবরণে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছে, তা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না। আইএস মাঠে থাকলে ইসলামকে সন্ত্রাসের সমার্থক বানাতে আর কারো কিছু করতে হবে না।দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকারের টনক নড়েছে। পিস টিভি বন্ধ করা হয়েছে। তবে পিস টিভি বন্ধ হলেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে, জঙ্গি তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে; এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ড. জাকির নায়েক এতদিনে যাদের বিভ্রান্ত করেছেন, নজর রাখতে হবে, তাদের দিকেও। শুধু পিস টিভি নয়, ড. জাকির নায়েকের আদর্শে বাংলাদেশে চালু আছে ১৪টি পিস স্কুল। এই স্কুলগুলো সাধারণ পাঠ্যসূচির বাইরে নিজেদের মতো কিছু বই পড়ানো হয়। তাই খোঁজ নেয়া দরকার পিস স্কুলের পাঠ্যসূচির দিকেও। নিষিদ্ধ করতে হবে পিস প্রকাশনাও।তাছাড়া সারাদেশে মসজিদগুলো কারা নিয়ন্ত্রণ করে, শুক্রবার জুমার নামাজের সময় সেই মসজিদে কী খুতবা দেয়া হয়, নজর দিতে হবে সেদিকেও। সরকার ইতোমধ্যে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সারাদেশে তিন লাখ মসজিদ মনিটর করা সহজ নয়। কিন্তু যত কঠিনই হোক, প্রশ্নটা যখন অস্তিত্বের, তখন তা করতেই হবে। এগিয়ে আসতে হবে জনগণকেও। কোনো মসজিদে কেউ বিভ্রান্তিকর কিছু বললে, প্রতিবাদ করতে হবে তাৎক্ষণিকভাবে। জঙ্গি সমস্যা নিছক আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা নয়। এটা মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে প্রকৃত ইসলামের শান্তির বাণী।এনএফ/এমএস

Advertisement