ঈদ মানে উৎসব। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদে ছোটবেলার আনন্দটাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। নতুন জামা পরা, মিষ্টান্ন খাওয়া, এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরতে যাওয়া এসব তো ছিলই বাড়তি ছিল ঈদের সালামি। প্রথম ঈদের সালামি কত বছর বয়সে, কত ছিল ঠিক মনে নেই। কিন্তু প্রথম দিকে ৫-১০ টাকার বেশি ছিল না আর যখন দেশ ছেড়েছি তখন সর্বোচ্চ সালামি পেয়েছি ৫০-১০০ টাকা। আমি একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম নিয়েছি। আর পরিবারের সদস্য সংখ্যাও ছিল অনেক। আমরা ছয় ভাই দুই বোন। ভাইয়েরা আমার থেকে অনেক বড়। আমার জন্মের আগেই কয়েক ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যায় এবং তাদের সন্তানাদিও হয়। তাদের মধ্যে কেউ আমার চেয়ে বড় আবার কেউ আমার সমান সমান। আবার কেউ আমার থেকে কিছুটা ছোট। সুতরাং, ঈদ এর সময় যে আমার বাবা এর উপর একটা ভালো চাপ ছিল তা বড় হওয়ার পর বুঝেছি। বাবা ছিলেন পরিবারের এক মাত্র কর্তা, তার উপর আট ছেলে-মেয়ে, নাতী-নাতনী সবার দায়িত্ব। আর বাবা যে শুধু নিজের পরিবার কে দেখতেন তাও নয়, তার বাজেটের মধ্যে থাকতো উনার ভাতিজা-ভাতিজী, ভাগনা-ভাগ্নি, গরীব দুখী অসহায় মানুষরা। ঢাকার আর নিজ গ্রাম এর মানুষ। তার কাছ থেকেই শেখা কিভাবে সুখ আর আনন্দ ভাগ করলে আনন্দ আরও বাড়ে। উচ্চ মধ্যবিত্তের পরিবারের মেয়ে হলেও, আমার মনে আছে বাবা বেঁচে থাকতে দুই ঈদ এ নতুন কাপড় কিনা হতো না। রোজার ঈদ এ যা কিনা হতো তা আবার উঠিয়ে রাখতে হতো কোরবানি ঈদের জন্য। ঐ যে বললাম বাবাকে অনেক কিছু দেখতে হতো। ছোট বেলায় পাশের বাড়ির সঙ্গীদের দুই ঈদ এ দুই রকম নতুন জামা পড়তে দেখলে ঠিকই মন খারাপ হতো। অনেকের একই ঈদে তিন বেলায় তিন রকমও নতুন পোশাক থাকতো। কিন্তু আমার বাবা ঐ রকম বিলাসিতার মধ্যে আমাদের বড় করেননি, শেখাননি। যা আমি বড় হয়ে অনুধাবন করেছি যে সবার সাথে সুখ-আনন্দ ভাগ করে নেওয়াই আসল প্রাপ্তি আর সেই প্রাপ্তিতেই আনন্দ। তবে ছোটবেলার বাংলাদেশে কাটানো ঈদ গুলো ছিল অন্য রকম মজার। ভোর বেলায় উঠে গোসল করে, নতুন জামা পরা, তারপর মায়ের বানানো মজার মিষ্টি জাতীয় খাবার গুলো প্রথমেই খেয়ে ফেলা, তারপর সবার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করা, কখন সবাই ঈদের নামাজ থেকে আসবে আর সালাম করবো, সালামি নিব, তারপর পাশের বাসায় যাব ঈদের কাপড় দেখাতে, আরও কিছু সালামি পেতে, আরও কিছু মজার খাবার খেতে। আর বিকাল হলেই বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার বায়না। তা চলতো ঈদের পরের দিনও। আমি খুব বেশি বয়স পর্যন্ত ঐ মজা গুলো পাইনি কিন্তু যতদিন পেয়েছি তা বুকে গেঁথে আছে, আর থাকবে চিরদিন। বাবা মারা যাওয়ার পর খুব অল্প বয়সেই মা পাঠিয়ে দেন আমাকে আয়ারল্যান্ড এ পড়াশুনার জন্য। প্রথম প্রথম ঈদে বাংলাদেশে চলে যেতাম। কিন্তু তখন আমার পড়াশুনার ক্ষতি হতো, কেননা ঈদে আয়ারল্যান্ডে কোনো সরকারি/বেসরকারি ছুটি নেই। বাংলাদেশের মানুষ একভাবে সৌভাগ্যবান যে মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হয়েও তারা ঈদ, দুর্গা পূজা, বড়দিন যেকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে সরকারি ভাবে ছুটি পাচ্ছেন। অন্যান্য দেশ এর কথা জানি না, কিন্তু আয়ারল্যান্ড ক্যাথোলিক প্রধান রাষ্ট্র, আর হয়তো তাই ঈদ বা পূজা বা অন্যান্য ধর্মের জন্য কোনো পাবলিক হলি ডে/ সরকারি ছুটি থাকে না। আমার মনে হয় কেউ কোনো আবেদন অথবা প্রস্তাবও করেনি এই ব্যাপারটিতে (ছুটির ব্যাপারে)। সবাই কেমন যেন মেনে নিয়েছে। যাই হোক, যা বলছিলাম প্রথম দিকে ঈদে দেশে যাওয়াটা পড়াশুনার জন্য ক্ষতি আর ব্যয়বহুল ছিল আর পরবর্তীতে চাকুরি শুরু করার পর ঈদে দেশে যাওয়ার জন্য লম্বা ছুটি পেতাম না। বছরে চাকরি থেকে ছুটি পেতাম পাঁচ সপ্তাহ। আর যেহেতু চাকরি করা অবস্থায় নিজের পড়াশুনাও চালিয়ে রেখেছিলাম, তাই ঐ পাঁচ সপ্তাহ বাঁচিয়ে রাখতে হতো সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার জন্য। কিন্তু এটা সত্যি যে, পাইলট হওয়ার আগে অন্তত ঈদের দিন আমি কখনো কাজ করিনি। ঈদ এর জন্য অন্তত ২ দিন বন্ধ নিয়েছি। আমার বর্তমান পেশা পাইলটিং একটু ব্যতিক্রম। যদি ঈদের দিনও আমার শিডিউল থাকে ফ্লাই করার, আবহাওয়া ভালো থাকলে অবশ্যই ফ্লাই করতে হয়। গত তিন/ চার বছর ধরে এমনটাই হচ্ছে। এর আগে ঠিকই আয়ারল্যাল্ডে ঈদ পালন করেছি। দেশ থেকে নতুন জামা পাঠাতো। সেই জামা পরে সকাল সকাল রেডি হয়ে বের হয়ে যেতাম। বাংলাদেশিরা যারা আছেন আয়ারল্যান্ডে তাদের বাসায় যেতাম ঘুরতে। কারো কারো অফিস বন্ধ থাকলেও হয়তো ঈদের দিন কাজও করতে হতো অনেককে। কিছু করার থাকতো না। তখন সালামি পেতাম না, কিন্তু প্রিপারেসন ছিল। নিউ হেয়ার স্টাইল, ড্রেস, জুতা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আমার মতো করে পালন করতাম। আসলে যেকোনো উৎসব সেলিব্রেট করা নিজের উপর, আমি মনে করি। আমি অনেককেই দেখেছি নিজেদের ভরপুর মানুষদের মাঝেও সেলিব্রেট করছে না, নেই কোনো প্রাণ। আসলে ঈদ এমন একটা ধর্মীয় উপলক্ষ বা অনুষ্ঠান যেটাতে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ, রাগ, কষ্ট, অভিমান অনেক অংশে কমিয়ে আনে। জীবনে আনে প্রাণ। নতুন ভাবে উজ্জীবিত করে। ঈদ নিয়ে দুঃখের বা কষ্টের কোনো কথা বলতে চাই না, তারপরও কিছু কথা না বললেই নয়। আয়ারল্যান্ডে ঈদে প্রথমেই কান্না দিয়ে ঝেড়ে ফেলতাম সব দুঃখ-কষ্ট। প্রচণ্ড রকমের মিস করতাম নিজের পরিবারকে। শরীরটা থাকতো আয়ারল্যান্ডে আর মনটা পড়ে থাকতো দেশে। মা মারা যাওয়ার পর কষ্টের তীব্রতা আরও বেড়েছে দিন দিন। গত আট বছর ধরে আর কেউ জিজ্ঞেস করে না, ‘কিরে কি রান্না করবি ঈদে? কি খাবি, কোথায় কোথায় যাবি? ঈদে র সকালে স্কাইপ-এ আর কেউ আমাকে দেখতে চায় না। আর কেউ কোরবানির ঈদের পর আমার কাছে কোরবানির মাংস পাঠানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠে না। আসলে মা তো মা-ই। মা চলে যাওয়ার পর পৃথিবী শুন্য, ঈদ শুন্য হয়ে পড়েছে। এখন আমার জগত জুড়ে আমার দুই সন্তান। ছেলে বড় আর মেয়ে ছোট। ওদের বাবা-মা দুটাই আমি। বুকে খুব ব্যথা অনুভব করি যদি ঈদের দিন আমার ফ্লাই করতে হয়। ওরা এমনিতেই ঈদ কি জিনিস এখনও বুঝতে পারে না যেহেতু ওরা দেশ এর মতো ঐ ঈদ কালচার টা আয়ারল্যান্ডে দেখে না, তাই অনুভবও করে না বা শিখে না বা ঐ ধরনের উত্তেজনা ওদের মধ্যে কাজ করে না, যা আমাদের করতো পুরো এক মাস জুড়ে, হয়তো আরও বেশি, বছর জুড়ে, কবে আবার ঈদ আসবে। তারপরও আমার একার পক্ষে আয়ত্তে যতখানি আছে আমি বলি বা করি। আসলে জীবনে তো অপ্রাপ্তি কিছু না কিছু থেকেই যায় কিন্তু জীবনের প্রাপ্তি গুলো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে আর তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকলে জীবনকে সুন্দর ভাবে উপভোগ করা যায়। জীবন কে একটু অন্য ভাবে দেখলে এবং দৃষ্টিভঙ্গিটা ইতিবাচক হলেই জীবনটা সুন্দর মনে হয়। সবচেয়ে মনে প্রশান্তি আসে যখন আপনি আপনার সুখ আনন্দ গুলো আপনার সমাজের দুখী, অসহায় গরীব মানুষগুলোর সঙ্গে ভাগ করে নেবেন। তাদের জন্য কিছু ভাববেন, তাদের জন্য কিছু করবেন। লোক দেখানোর প্রবণতা থেকে বের হয়ে, যখন আপনার পোশাক কেনার টাকা থেকে কিছুটা অংশ যখন আপনি অন্য কোনো গরীবকে একটি পোশাক কিনে দিবেন, তখন তার চোখে তাকিয়ে দেখবেন তার চোখে কি আনন্দ, তার মুখে কি হাসি যা অমূল্য। আমার কাছে তার চেয়ে খুশির আর প্রশান্তির কিছু হতে পারে না। আসুন না, আমরা সবাই মিলে ঈদ উপভোগ করি। আমার, আপনার আশে-পাশের দরিদ্র মানুষ গুলো নিয়েই ঈদ উপভোগ করি। তাদেরকে এক বেলা ভালো কিছু খাওয়াই। তাদের কথা এক বার ভাবি। আমার, আপনার জন্ম তো ঐ গরীব ঘরেও হতে পারতো, কিন্তু আমরা সৌভাগ্যবান। আসুন আমাদের ভাগ্যকে শেয়ার করি ঐ দুর্ভাগাদের জন্য যাদের এক বেলা ঠিক মতো খাবার জোটে না, ঈদে নতুন কাপড় তো দূরের কথা।লেখক : বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মিজ আয়ারল্যান্ড (২০১৪) মিজ আর্থ (২০১৬), মডেল ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। পেশাগত জীবনে বৈমানিক।এইচআর/এমএস
Advertisement