আবুল ফজল (১ জুলাই ১৯০৩- ৪ মে ১৯৮৩) আমার পিতা। গত পয়লা জুলাই তাঁর ১১৪ বছরের জন্মদিন অতিবাহিত হল। দক্ষিণ চট্টগ্রামের অত্যন্ত সুখ্যাত কিন্তু গোঁড়া মৌলভী বাড়িতে জন্মে তিনি বাংলা সাহিত্যের সাধনা করেছেন। সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন প্রবন্ধ লিখে মূলত নিজ সমাজের কুসংস্কার ও সীমাবদ্ধতা ছিল তাঁর চর্চার বিষয়। বলা বাহুল্য তিনি ধর্মে আস্থাশীল থেকে সংস্কারকের দৃষ্টিতেই লিখেছেন। ছাত্রজীবনেই তিনি মনোযোগ দেন কথাসাহিত্যের দিকে। ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে অচিরেই নিজ সমাজ ও বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৌচির’ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছেন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে লেখা তাঁর চিঠি মুসলিম সমাজের বাংলাভাষা ও সাহিত্যসাধনার পথনির্দেশ হিসেবে কাজ করেছে। এই অমূল্য চিঠির মূল কপি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।১৯২৬ সনে সূচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন থেকেই তাঁর নিবিষ্ট সাহিত্যযাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। এ আন্দোলনের দার্শনিক নেতা ছিলেন মনীষী কাজী আবদুল ওদুদ (১৯৯৪-১৯৭০) এবং মনীষী আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮)। এঁরা দুজনেই ছিলেন মুক্তচিন্তার মানুষ, তাঁদের সাহিত্যান্দোলনের নীতিকথা ছিল চিন্তাগর্ভ এই বাক্যটি- জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। আবুল ফজল মনেপ্রাণে একথা বিশ্বাস করতেন।সামাজিক পশ্চাৎপদতার সাথে যখন পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের উস্কানিতে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতা দানা বেঁধে সাম্প্রদায়িকতা ও অগণতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিচ্ছিল তখন এই চিন্তাশীল লেখকের পক্ষে চুপচাপ থাকা সম্ভব হয়নি। গত শব্দাতীর ষাটের দশক থেকে আবুল ফজল মূলত একজন সমাজচিন্তক ও রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ সময় থেকে তাঁর কলমে কথাসাহিত্যের স্রোত একদম থেমে না পড়লেও স্তিমিত হয়ে খরস্রোতা হয়ে উঠেছিল মননশীল প্রবন্ধ। রাষ্ট্র সমাজ সংস্কৃতি তাঁর মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল তখন। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে গণতন্ত্র ও সামাজিক মুক্তি এবং মানবিক সংস্কৃতির পক্ষে ক্রমাগত তিনি তাঁর শক্তিশালী লেখনি চালিয়েছেন। লৌহমানব আয়ুবের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি গণতন্ত্র ও স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। এ সময় বাংলাদেশে যে বিপুল গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তার মতাদর্শিক ভিত নির্মাণে আবুল ফজলের চিন্তা গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাধিকবার পত্র যোগাযোগ করে তাঁর বিভিন্ন লেখা পুনর্মুদ্রণ করে দেশবাসীর কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য বাবা তাতে সানন্দে রাজি হয়েছিলেন। ক্রমে সাহিত্যাঙ্গনের বাইরে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি একজন পদপ্রদর্শক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।স্বাধীনতার পরেও তিনি মুক্তচিন্তার সাহসী প্রকাশ ঘটিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার প্রেক্ষাপটে তখনকার পরিবেশে তিনি গল্পের আড়ালে হত্যাকারীদের বিষয়ে জনমত গড়তে সাহায্য করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে স্মৃতিচারণ করেছেন যা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কখনো থামেন নি মানুষের অধিকার আদায়ের দাবি থেকে। দীর্ঘ এই ধারাবাহিক ভূমিকার ফলে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ আবুল ফজলকে সত্তরের দশকে ‘বাংলাদেশের বিবেক’ অভিধায় ভূষিত করেছিল।তাঁর দৃঢ় নৈতিক ভূমিকা, মানবিক চেতনা, গণমুখি আদর্শবাদ, বিপন্ন মানুষের প্রতি সহৃদয় অবস্থানের কারণে আবুল ফজলকে এক উচ্চ আদর্শের নৈতিক মানুষ হিসেবে সমাজ মূল্য দিয়েছে। রাষ্ট্রও তা অস্বীকার করতে পারে নি। তিনি পাকিস্তান আমলে কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আত্মজীবনী রেখাচিত্রের জন্যে আদমজী পুরস্কার এবং সামগ্রিক অবদানের জন্যে প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ আমলেও সমকাল ও মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক এবং শেখ হাসিনার প্রথমবারের শাসনামলে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন।তাঁর মৃত্যুর পরে ইতিমধ্যে তেত্রিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে, ২০০৩ সালে তাঁর জন্ম শতবর্ষ পালিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলাভাষার অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের মতই, এবং তাঁর নিজের চিন্তাগুরু কাজী আবদুল ওদুদের মত, তাঁকেও পরবর্তী প্রজন্ম তেমনভাবে আর মনে রাখছে না, চর্চা করছে না।কিন্তু আজও এ সমাজে এবং এই রাষ্ট্রে আবুল ফজলের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা বহাল রয়েছে। আমাদের আকাক্ষিত বাংলাদেশ কি আমরা পেয়েছি? আজ বরং ধর্মান্ধতা চেপে বসে তা থেকে জঙ্গিবাদের জন্ম হয়েছে, রাজনীতি ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে বলি হয়ে আদর্শহীন হয়ে পড়েছে, মানুষ ভোগ ও ব্যক্তিগত অর্জনের পথে নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার গণতন্ত্রকে খর্ব করে রেখেছে। আর অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরীক্ষার চাপে পড়ে শিক্ষা আজ সম্পূর্ণ লক্ষ্যচ্যূত, দিশাহীন। বাণিজ্যায়নের দাপটে সংস্কৃতিও লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাঁর মৃত্যুর প্রায় তিন যুগ পরেও আবুল ফজল একজন সাহসী চিন্তাবিদ, নির্ভীক লেখক এবং মানবতাবাদী বিবেকবান নাগরিক হিসেবে আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আজকের বাস্তবতায় অনেক সময় তাঁকেও, যেমন বেগম রোকেয়াকে, মনে হয় রীতিমত দুঃসাহসী লেখক। কিন্তু মত প্রকাশের সাহসী পথিকৃৎদের স্মরণ এবং মূল্যায়ন ও অনুসরণ আজ সময়ের দাবি।আবুল ফজলের সমধর্মী অগ্রজ, সমসাময়িক ও অনুজ অনেকেই গত শতাব্দীতে মানবিক সমাজের নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছিলেন এদেশে। আজ তাঁদের পথ শ্যাওলা-গুল্ম জমে ঢেকে যাচ্ছে, সেটা আমাদের জন্যে লজ্জার এবং বেদনার বিষয়। দেশের ও মানুষের সত্যিকারের মুক্তির জন্যে আবুল ফজল ও তাঁর মত মনীষীদের প্রদর্শিত পথ সবার জন্যে মুক্ত করে দেওয়া দরকার। তাতেই দেশের মঙ্গল হবে।লেখক : কবি, সাংবাদিক ও সমাজচিন্তকএইচআর/পিআর
Advertisement