আজকাল দেড়শ স্ট্রাইক রেটে সেঞ্চুরি হচ্ছে গণ্ডায় গণ্ডায়। সেখানে ১৮৯ বলে ১৩৮ আর এমনকি? কিন্তু খেলাটা যখন টেস্ট, এবং যখন শুনবেন এটা টেস্টে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত স্কোর তখন নিঃসন্দেহে বলবেন, ‘বাহ ভালোইতো’! আর যদি শোনেন প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া, তাহলে বলবেন, ‘হুম, সত্যিকার মেধাবী ব্যাটসম্যানরাই পারে অমন ইনিংস সাজাতে।’সময়টা ২০০৬; যখন ক্রিকেট বিশ্বে একক আধিপত্য ছিল অস্ট্রেলিয়ার। জানবেন সে দলে ছিলেন কিংবদন্তি লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন, গতিদানব ব্রেট লি, আরেক লেগি স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল এবং জেসন গিলিস্পির মত ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলার তাহলে নিশ্চয় ইনিংসটিকে সেরা কাতারে রাখতে দ্বিধা বোধ করবেন না। এ বিস্ময়কর ইনিংসটি খেলেছিলেন শাহরিয়ার নাফীস। যাকে ভাবা হয় একজন পরিপূর্ণ ওপেনার। ক্যারিয়ারের সূর্য যখন মধ্য আকাশে, ঠিক তখন হঠাৎ ছন্দপতন। তারপর প্রায় হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু সত্যিকার যোদ্ধারা কখনো হার মানে না। তাই আবারও বীরদর্পে শিরোনামে ফিরেছেন শাহরিয়ার নাফীস। আগামী ইংল্যান্ড সিরিজ লক্ষ্য রেখে কন্ডিশনিং ক্যাম্পে ডাক মিলেছে এ স্টাইলিশ ওপেনারের।ইঙ্গিতটা দিয়েছিলেন গত মৌসুমেই। জাতীয় লিগে ছয় ম্যাচে ১১ ইনিংস ব্যাটিং করে তুলে নিয়েছিলেন ৭১৫ রান। তাতে ছিল চারটি হাফ সেঞ্চুরি আর দুটি দুর্দান্ত সেঞ্চুরি। সে মৌসুমের বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগেও ভালো করেন নাফীস। ছয় ম্যাচের ১০ ইনিংস ব্যাট করে একটি সেঞ্চুরি ও তিনটি হাফ সেঞ্চুরির সাহায্যে করেন ৪০২ রান। জাতীয় দলের দরজা হয়তো তখনই খুলে যেত। কিন্তু টি-টোয়েন্টির জোয়ারের কারনে প্রতীক্ষাটা দির্ঘায়িত হয় তার। তবে প্রাথমিক কন্ডিশনিং ক্যাম্পে ডাক পেয়ে বিস্মিত নাফীস। আর বিস্মিত হওয়াটাও স্বাভাবিক এ ওপেনারের। প্রায় নয় বছর জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার পর তিন বছর জাতীয় ক্রিকেট দলের কোথাও বিবেচনায় না থাকার পর এবারও থাকবেন না ভেবেছিলেন তিনি। ‘আসলে সত্যি বলতে আমি এখনও ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছিনা। বিশ্বাসই হচ্ছেনা আমি স্কোয়াডে আছি। গত তিন বছর থেকে আমি কোথাও নাই। তাই এটা আসলেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। তবে সুযোগ যখন পেয়েছি। চেষ্টা করবো এ সুযোগ কাজে লাগানোর। আমার কাজ হচ্ছে পারফরম্যান্স করে যাওয়া। এর জন্য আমি অনেক পরিশ্রম করে যাচ্ছি। এবং নিয়মিত আমি এ পরিশ্রম করে যেতে চাই।’ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম সেরা আসরে সর্বোচ্চ সংগ্রহকারী হয়েও জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক? তার উপর জাতীয় দলের খেলার অভিজ্ঞতাও আছে যার। এমন প্রশ্নে বিনয়ী নাফিস লাজুক হেসে বললেন, ‘এটা আপনাদের বিশ্বাস আর ভালোবাসা। আপনাদের ভালোবাসায় এই আমি আবার ফিরতে পেরেছি। এর জন্য আমি আমার সকল ভক্ত এবং দর্শকদের ধন্যবাদ জানাই। তারা আমার জন্য দোয়া করেছেন বলেই আমার ফেরার পথ পেয়েছি। চেষ্টা করবো তাদের সে ভালোবাসার সর্বোচ্চ প্রতিদান দিতে।’স্বপ্নের মত ২০০৬ সাল কাটানোর পর অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়েই ২০০৭ বিশ্বকাপে ক্যারিবীয়দের মাটিতে গিয়েছিলেন নাফীস। কিন্তু বিশ্বকাপটা ভালো যায়নি তার। এরপর ২০০৮ সালে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেন তিনি। ব্যাটে রান খরার পাশাপাশি আইসিএল ক্রিকেটে জড়িয়ে দশ বছরের নিষেধাজ্ঞায় পড়েন তিনি। দুবছর পর সেখান থেকে ফিরে আসলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয় তার। এরপর ২০১০ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজ দিয়ে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন নাফীস। ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলার পর আবার বাদ পড়েন তিনি। এরপর আর জাতীয় দলের জার্সি পরার সৌভাগ্য হয়নি তার। সেই সময় গুলো এখনো বেদনার কাঁটা হয়ে বিঁধছে। তাইতো কন্ঠে এমন কষ্টের সংলাপ, ‘আমার জন্য সে সময়গুলো ছিল খুব কষ্টের। আমি আপনাকে বুঝাতে পারবো না। একটা খেলোয়াড় নয় বছর খেলার পর হঠাৎ বাদ হয়ে গেলে কষ্টটা কেমন হয় যে পড়েছে সেই জানে। তবে ধন্যবাদ আমার পরিবারকে। সবাই আমাকে বুঝিয়েছে বিশেষ করে ফাহিম স্যার বলেছেন এ সময় তুমি তোমার দুর্বলতাগুলো নিয়ে কাজ করে যাও। আমি কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’ দীর্ঘদিন পর আবার জাতীয় দলের খেলার স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে নাফীসের। কিন্তু এতেই আহ্লাদিত হয়ে যাচ্ছেন না তিনি। কঠোর পরিশ্রম ও নিয়মিত অনুশীলন করে ফিরতে চান কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। তবে স্বপ্নের প্রথম ধাপে পৌঁছে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে ভোলেননি তিনি। ‘প্রথমে আমি শুকরিয়া আদায় করি মহান আল্লাহর। কারণ তিনি না করলে কিছুই হওয়া সম্ভব হয়না। অবশ্যই আমার স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ আমার খারাপ সময়ে ও পাশে থেকে আমার সাহস যুগিয়েছে। এরপর ফাহিম স্যার, তিনি সবসময় আমাকে নিয়ে কাজ করেছেন। আমার যেখানে দুর্বলতা ছিল তা নিয়ে আলাদা কাজ করেছেন। তার ব্যস্ত সময়ের মাঝেও আমাকে সময় দিয়েছেন।’বাস্তবতা কত কঠিন তা ভালো করেই জানেন নাফীস। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় দল সমান তালেই লড়াই করছে বাঘা বাঘা দলগুলোর বিপক্ষে। ওয়ানডে দল অনেকটাই সেট। তাই চূড়ান্ত দলে জায়গা করে নেওয়া অনেক কঠিন হবে জানেন তিনি। তবে হাল ছাড়ার পাত্র নাফীস নন। ক্যাম্পে নিজের কাজগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে করতে চান তিনি। কঠোর পরিশ্রম করেই জায়গা করে করতে চান তিনি। ‘আমার বর্তমান লক্ষ্য কন্ডিশনিং ক্যাম্পের কাজগুলো ঠিকভাবে করা। বর্তমান দলে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। আমি জানিনা আমি খেলবো কিনা। তবে যদি সুযোগ পাই যে কোন পজিশনে যে কোন সময় পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার। ধরেন দলের যদি প্রয়োজন হয় ২০০ বলে ৫০ করা তাহলে আমি তাই করবো। আবার যদি দরকার হয় ১০০ বলে ১০০ করা তাহলে তাই করার চেষ্টা করবো।’ ঈদের পর আগামী ২০ জুলাই শুরু হচ্ছে টাইগারদের কন্ডিশনিং ক্যাম্প। প্রিমিয়ার লিগ শেষ হয়ে যাওয়ায় পর সব খেলোয়াড়রাই রয়েছেন ছুটিতে। তবে নাফিস ছুটিটা একটু আগেই পেয়েছিলেন। তার দল ব্রাদার্স সুপার লিগে উঠতে ব্যর্থ হয়। তাই ঈদের দুদিন পরই অনুশীলনে নেমে পড়বেন তিনি। প্রায় মাস খানেকের অনুপস্থিতি ও ক্যাম্পে নিজেকে পূর্ণ ফিট রাখার লক্ষ্যেই নামছেন বলে জানান এ ওপেনার।আরটি/পিআর
Advertisement