খেলাধুলা

আটত্রিশেও চির তরুণ বুফন

(জাগো চ্যাম্পিয়নের পঞ্চম সংখ্যায় প্রকাশ হওয়া ইতালি গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফনকে নিয়ে এই লেখাটা আজও বেশ প্রাসঙ্গিক। ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেনের বিপক্ষে যে গোলকিপিং তিনি করেছেন তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। সে কারণেই জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য চ্যাম্পিয়নের লেখাটি আবারো তুলে ধরা হলো)তাকে মনে করা হয় ইতালির ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা গোলরক্ষক, কেউ কেউ তাকে তার প্রজন্মেও সেরা গোলরক্ষক হিসেবেও মানেন। ২০০৬ সালের ইতালির বিশ্বকাপজয়ী দলের একজন গর্বিত সদস্য। শুধু একজন গোলরক্ষকই নয়, পাশাপাশি একজন নেতৃত্বদানকারী এবং দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রেরণার যোগানদানকারী।এতক্ষণে হয়তো বুঝে গেছেন কার সম্পর্কে কথাগুলো বলা হচ্ছে। তিনি আর কেউ নন, সবারই কম-বেশি প্রিয় একজন খেলোয়াড়, গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফন। কেউ কেউ তো ৩৮ বছর বয়সী এই ফুটবলারকে লেভ ইয়াসিন, তাফারেল, গিলিমার ডস সান্তোস, অলিভার কান, ইকার ক্যাসিয়াসদের সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করে দিয়েছেন।জিয়ানলুইজি বুফন ১৯৭৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ইতালির কারারা নামক শহরে ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা একজন ভারোত্তোলনকারী এবং মা একজন গোলক নিক্ষেপকারী ছিলেন। ভেরোনিকা এবং জুয়েনডালিনা নামে ২ জন বোনও রয়েছেন, যারা ইতালি জাতীয় ভলিবল দলের হয়ে খেলেছেন। বুফন এখন গোলরক্ষক হলেও ফুটবলের শুরুটা কিন্তু তার গোলপোস্টের নিচে শুরু হয়নি। ছোটবেলায় তিনি ছিলেন একজন মিডফিল্ডার।তবে মাত্র ১১ বছর বয়সে ক্যামেরুন জাতীয় দলের গোলরক্ষক টমাস এন’কোনোকে আদর্শ হিসেবে মেনে বুফন নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে গ্লাভস হাতে দাঁড়িয়ে যান গোলবারের নিচে। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই পারমা ফুটবল ক্লাবের যুব অ্যাকাডেমিতে যোগদান করেন। ১৭ বছর বয়সে পারমা ফুটবল ক্লাবের যুব অ্যাকাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষে পারমা ক্লাবের মূল দলে যোগ দেন। সেখান থেকেই তার খেলোয়াড় জীবনের শুভসূচনা।পারমা ফুটবল ক্লাবে ৬ বছর অতিবাহিত করার পর ২০০১ সালে ৩২.৬ মিলিয়ন পাউন্ডে পারমা ফুটবল ক্লাব থেকে যোগ দেন জুভেন্তাসে। এটি আজও বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে একজন গোলরক্ষক হিসেবে সবচেয়ে বড় ট্রান্সফার ফি’র রেকর্ড।ব্যক্তিগত রেকর্ড থেকে শুরু করে ক্লাব এবং দেশের হয়ে বুফনের সাফল্যের হিসাব কষতে গেলে শেষ করা অসম্ভব। বর্তমান প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীরা যখন থেকে খেলা দেখা শুরু করেছে, তখন থেকেই তারা পরিচিত বুফনের সঙ্গে। আধুনিক ফুটবলে এত দীর্ঘসময় কেউ একটি দেশের গোলপোস্টেও নিচে ছেলেন কি-না সন্দেহ। একজন ইতালিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার রেকর্ডও বুফনের।৯ বার নির্বাচিত হয়েছেন ইতালিয়ান সিরি আ’র বর্ষসেরা গোলরক্ষক। সিরি আ এবং ইতালির হয়ে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে গোল না হজম করার রেকর্ড তার। ২০০৩ সালে বুফন বিশ্বের সেরা গোলকিপার হিসেবে মনোনিত হয়েছিলেন। ৩ বার জায়গা পান উয়েফা বর্ষসেরা দলে (২০০৩, ২০০৪, ২০০৬) এবং ২ বার ফিফা বিশ্বসেরা দলের (২০০৬, ২০০৭) গোলরক্ষক নির্বাচিত হন। একজন গোলরক্ষক হিসেবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক (৫ বার) বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার রেকর্ডটাও নিজের করে নিয়েছেন ইতালির অধিনায়ক।বুফনের ক্যারিয়ারের সেরা সময় ২০০৬ সাল, যখন মার্সেলো লিপ্পির ইতালি জার্মানিতে জিতে নেয় বিশ্বকাপ শিরোপা। পুরো টুর্নামেন্টে ৪০টি সেভ করে তিনি হন সেরা গোলরক্ষক। অর্জন করেন লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড। ওই বছরই ভেঙে দেন তার সাবেক সতীর্থ ফ্যাভিও ক্যানাভারোর ইতালির হয়ে খেলা সর্বাধিক ১৩৬ ম্যাচের রেকর্ড। অথচ এই সুন্দর সাফল্যগাঁথায়ও কাঁটার মতো বিঁধে আছে দুটি অপ্রাপ্তি, কখনো ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে পারেননি জিয়ানলুইজি বুফন।২০০৩ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ফাইনালে হেরেছিলেন এসি মিলানের কাছে টাইব্রেকারে, আর গত বছর হেরেছেন বার্সেলোনার কাছে। আর ইউরোতে ইতালির হয়ে বুফন দুইবার ফাইনালে উঠলেও, ২০০০ সালে তখন চোটের কারণে টুর্নামেন্টেই খেলতে পারেননি তিনি। ২০১২ সালে ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে ইংল্যান্ডের অ্যাশলি কোলের শট বাঁচিয়ে দলকে সেমিফাইনালে তুলেছিলেন। সেমিতে জার্মানির সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন ‘চীনের প্রাচীর’ হিসেবে। পুরো ৯০ মিনিট জার্মানির বিপক্ষে একাই লড়াই করেন তিনি। ৯২ মিনিটে পেনাল্টিতে গোল হজম করেও ২-১ গোলে জয়ী হয়ে ইতালি পৌঁছে যায় ফাইনালে।তবে স্পেনের বিপক্ষে শিরোপা যুদ্ধে ইতালির ছন্দপতন হলে ৪-০ গোলে হার মানে আজ্জুরিরা। ইতালির হয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপ জেতার সময়টায় ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে ছিলেন বুফন। ওই প্রজন্মের সেরাদের সেরাও ছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় ৩৮-এ পা রাখা বুফনের এখন আর আগের সেই ধার নেই। ১৯৯৭ সালে ইতালির হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পর যেন ইতালিরই সমার্থক হয়ে গেছেন তিনি! এবারো তার নেতৃত্বে ইউরো খেলছে ইতালি।৩৮ বছর বয়সে আধুনিক পাওয়ার ফুটবলের যুগে গোলকিপিং করাটা কত কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। ইউরোর এবারের আসরে সবচেয়ে বর্ষিয়ান খেলোয়াড়দের একজন বুফন। এ বয়সে একজন গোলরক্ষকের রিফ্লেক্স, এরিয়াল এবিলিটি, মুভমেন্ট সবই বয়সের ভারে শ্লথ হয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু বুফন খেলেই চলেছেন অতিমানবীয় দক্ষতায়। এরই মধ্যে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলো নিশ্চিত করে ফেলা বুফন নিশ্চয়ই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন তার প্রথম ইউরো শিরোপা স্বাদ নিতে।এই ইউরো তার অষ্টম প্রথম সারির টুর্নামেন্ট। জার্মান সুপারস্টার লোথার ম্যাথিউসই একমাত্র ফুটবলার, যিনি নয়টি প্রথম সারির আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেছেন। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ খেলে বুফন এটি স্পর্শ করবেন তা কে জানে! তবে তার সামনে রয়েছে তার গুরু দিনো জফের উদাহরণ। দিনো জফ ৪০ বছর বয়সে জিতেছিলেন বিশ্বকাপ (১৯৮২)। বুফন হয়তো এটিকেই তার ‘বিগেস্ট মোটিভেশন’ মনে করতে পারেন।তবে ২২ বছরের ক্যারিয়ারটা আর বেশিদিন দীর্ঘায়িত করবেন না এই তারকা। এরই মধ্যে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের পর বর্ণাঢ্য পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানার ইঙ্গিত দিয়েছেন ইতালিয়ান কিংবদন্তি জিয়ানলুইজি বুফন।জাগো চ্যাম্পিয়নের পঞ্চম সংখ্যা পড়তে ক্লিক করুণ এই লিংকেআইএইচএস/বিএ

Advertisement