মতামত

চরিত্রে কলংক নেয়ার জন্য হলেও বাঁচা জরুরি

এখন যদি আমরা কিছু বলি তবে প্রথমেই শুনতে হবে, ‘খেপছে, নারীবাদীরা খেপছে।’ এই যে "নারীবাদীরা" বলে ঠোঁটের কোণে হাসা, এইটাতে অভ্যস্ত হতে আমার অন্তত: সময় লাগবে। আমার গায়ের চামড়া অত মোটা না। এখনও আমার ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে, এখনও আমি গালি দিতে পারি। এখনও আমি সপাটে থাপ্পড় লাগাতে পারি। কিন্তু মৃত মিতু? সে কি উঠে চড় লাগাতে পারবে? আমার বারবার মনে হয়, আমরা শুয়োরের খোঁয়াড়ে বাস করি। অনলাইন পোর্টালগুলোর অসমর্থিত সূত্র দাবি করেছে মিতুর পরকীয়া ছিল। বিরক্ত, ক্ষিপ্ত স্বামীই তাকে মারিয়েছেন। নিউজরুমে ফিসফাস শুনি। না কেউ এই অসমর্থিত সূত্রকে আপ্যায়ন করেনি। বরং রাগ দেখিয়েছে। একজন বলল, "আপা, দ্যাখেন, মৃত এক মহিলাকে নিয়ে কীসব কথাবার্তা। তার চরিত্র কেমনে হনন হচ্ছে।" আমি কথা বলিনা। মিতু প্রেম করলে এবং সেই কারণে তাকে মারা হয়েছে এইটা বললে তার চরিত্র হনন হয় বলে আমি মনে করি না। প্রেমে কোন পরকীয়া, আপনকীয়া আছে বলেও আমি মনে করিনা। এইসব শব্দের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ ঘোষণা করছি।"নারীর চরিত্রে কলংকলেপন" টাইপ শব্দও আমি অস্বীকার করছি। চরিত্র থাকলে তাতে কলংকও থাকতে পারে, কেউ দেবী-ঈশ্বরী না। কিন্তু ভাই, চরিত্রে কলংক লাগাতে হলে তো আপনাকে আগে বেঁচে থাকতে হবে তাইনা? একটা পুরুষকে পেটালে যেরকম ব্যথা লাগে, নারীকে পেটালেও তাই। মরেছে যে মিতু তার কি কম ব্যথা লেগেছে? সে কি কম যন্ত্রণা পেয়ে মরেছে? সাংবাদিকতার পাঠ দেওয়া আমার কাজ না। তার জন্য বড় ভাইয়েরা আছেন। কতশত কর্মশালা, কতশত সেমিনার,সিম্পোজিয়াম এইগুলা যে "ফেলা" যায় তা আমরা আগেও অনেকবার দেখেছি। কিন্তু আমি কি বলি জানেন, যে সাংবাদিকরা পোর্টালগুলোতে অসমর্থিত সূত্রের নামে এসব লিখেছে তাদের মনের ভেতরেই শুধু ধর্ষক, বিকৃত মন বাস করে তা কিন্তু না, যে আপনি শেয়ার দিচ্ছেন, যে আপনি " এইটা কি সত্য নাকি!" বলে নীরিহভাবে বিস্ময়বোধ দেখাচ্ছেন, "লোকটা কি নিপুণ অভিনেতা" বলে বাবুল আকতারের কান্নার ছবি কোলাজ করে পোস্ট দিচ্ছেন- ধর্ষকাম আপনার মধ্যেও পুরো মাত্রায় বিদ্যমান। ঐ সাংবাদিকেরা যেমন সত্য (বা মিথ্যা), আপনিও কম সত্য (বা মিথ্যা) নন। তাই ঘটনাটার বিচার করেন। সঠিক এবং আইনের শাসনের পথে। আমরা এই লাইনেই কথা বলে যাবো। অসমর্থিত সূত্রও তাদের দাবি করেই যাবে। এই শুয়োরের খোঁয়াড়ে দুইটাই চলবে। একটা ঘটনা ঘটেছে, সেই ঘটনাকে নানাভাবে আলো ফেলে দেখা হবে, তদন্ত কেমনে হবে না হবে সেই নিদান তো আমার আপনার মতো নাদানরা দেবো না ফেসবুকে বসে বসে। তদন্তকারীদের কাজটা করতে দেই আমরা। আর আমাদের কাজ হলো, বিচার ঠিকঠাক না হলে চিৎকার করে বিচারটা চাওয়া। আর বিচার চাইতে হলে বাবুল আকতারের নামের আগে হ্যাশট্যাগ হিরো লাগাতে হবে এর মানে কি? সম্ভবত: দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিক আইন-কানুনের মধ্যে না থাকতে থাকতে সবকিছু নিয়ে ফ্যান্টাসাইজ করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমাদের ডাক্তাররা রোগী দেখতে গেলে সবার আগে বলেন, "আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন" আমাদের পুলিশ কর্মকর্তারা মিতু হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেন-বলেন ‘এইসব কিসের লক্ষণ’? বাবুল আকতার হিরো না হলে এই খুনের বিচার হবে না? তনু বোন না হলে তার ধর্ষণের বিচার হবে না? ব্লগাররা ধর্ম মানেন না বলে তাদের হত্যার বিচার চাওয়া যাবে না? এবং সম্ভবত: এইসবই এখন আমাদের সমাজের মানুষের মানসিকতা। আর এই মানসিকতা থেকে বের না হয়ে এসে কোনকিছু শুদ্ধভাবে চাইতেও শিখবেন না আপনারা। মন থেকে, সৎভাবে চাওয়াটা দয়া করে শেখেন আবার। ততক্ষণ পর্যন্ত খুনের তদন্ত চলুক। আমরা বিচারের অপেক্ষায় আছি। আছি কিন্তু। মাঠ ছেড়ে যাইনি।লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, ডিবিসি নিউজএইচআর/এবিএস

Advertisement