মতামত

বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা প্রেম ভালোবাসা!

শরীফ (ছদ্মনাম) নামের যে ছেলেটা অনার্স পড়াকালীন সময়ে তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাবার কারণে, প্রায় ২৫-৩০টি ঘুমের বড়ি খেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিল, সেই শরীফ এখন জেডিএস এর স্কলারশিপ নিয়ে জাপানে পিএইচডি করছে। অথচ অনার্স পড়ার সময় প্রাক্তন প্রেমিকার পরিবার থেকে শরীফকে ‘হোপলেস’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছিল, অনার্স পাসই করতে পারবে না। রত্নার (ছদ্মনাম) সাথে ১২ বছর প্রেমের অভিনয় করে যে ছেলেটা অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করলো, শোক সইতে না পেরে রত্না ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে কাপড় প্যাঁচানোর সময় মায়ের চোখে ধরা পরে যায়। রত্না এখন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালো আছে।তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবো না, জীবন থেমে যাবে, সম্পূর্ণ অর্থহীন কথা। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। জীবনের জন্যই সব। জীবন আছে বলেই প্রেম, অভিমান, স্বপ্ন, দুঃখ সবকিছু আছে। জীবনে ব্যর্থতা আসতেই পারে। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, সবই সাময়িক সময়ের জন্য। পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া জামান (ছদ্মনাম) বার্ষিক ফলাফল দেখেই যদি লেখাপড়া বন্ধ করে দিত, তবে এসএসসি পরীক্ষায় বোর্ডস্ট্যান্ড করার আনন্দ সে কখনই পেত না। আজ সেই জামান একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে। জীবনটা কোনো সিনেমার অংশ নয় যে সব সমস্যার সমাধান তিন ঘন্টায় হয়ে যাবে। আর আত্মহত্যা করে আপনি কী প্রমাণ করলেন? নিজেকে শেষ করে অন্যকে কোনোদিন শিক্ষা দেয়া যায় না। বড় পর্দার নায়ক-নায়িকা, মডেল কিংবা অপরিচিত কেউ কেন আত্মহত্যা করল, তার বিশ্লেষণে যাব না। যারা চলে গেছে তাদের নিয়ে ঘাটাঘাটি করে কি হবে? কিন্তু যারা আছে, তাদের বলব, জীবনকে ভালোবাসুন। যে সারাজীবন আপনার পাশে থাকবে কথা দিয়েছে, সে হয়ত কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই কথাটি বলেছে। শুরুতেই সাবধান হোন। পরে দুঃখ পাবেন না। আপনার সকল সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। মাধ্যমিকের কারিকুলামে অনেক কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে, কিন্তু আত্মহত্যা বিষয়ক আদৌ কোনো অধ্যায় আছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে না থাকলে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। পরীক্ষায় পাস করতে হলেও সবাই পড়বে, জানবে এবং মনের মধ্যে তৈরি হবে দৃঢ়তা। আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, "যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরূপভাবে আত্মহত্যা করতেই থাকবে এবং উহা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। যে ব্যক্তি বিষ পানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতেই থাকবে, জাহান্নামে সে সর্বক্ষণ বিষ পান করে আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর উহা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। আর যে ব্যক্তি লৌহাস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সেই লৌহাস্ত্রই তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সে তা নিজ পেটে ঢুকাতে থাকবে, আর সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে"। কীসের আশায় আমরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছি? দুই মিনিটের হঠকারী সিদ্ধান্তে সব শেষ হয়ে যাবে মানা যায় না।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একদিন ক্লাসে আমার অত্যন্ত প্রিয় অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ স্যার প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা বলতে পারবে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা কোনটি’? আমরা প্রত্যেকেই কেউ রাজনীতি, কেউ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কেউ যানজট, কেউ সন্ত্রাস ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে লাগলাম। স্যার হাসলেন এবং উত্তরে বললেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হল প্রেম ভালোবাসা’। অনেকেরই প্রশ্ন, কেন স্যার? এবার তিনি ব্যাখ্যা দিলেন, ‘সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর একটু টিভির সামনে বসলেই, এমন কোনো নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা নেই যেখানে অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের প্রেমের বিষয় ছাড়া অন্য কোনো কিছু দেখানো হয়। যত ধরনের অঘটন, দাঙ্গা, হানাহানি সেই প্রেম নিয়েই হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা কি দাঁড়ালো? স্যার হয়ত রসিকতা করেই বিষয়টা বলেছিলেন, কিন্তু কথাটির তাৎপর্য অনেক বেশি ছিল।  একটি ক্রিকেট ম্যাচে শূন্য রানে আউট হলে, আপনার মন মেজাজ চরম খারাপ থাকবে। মনে হবে হাতের ব্যাট ভেঙ্গে ফেলি। সেই একই ম্যাচে যদি আপনি ৬টি উইকেট পেয়ে ম্যাচ সেরা হন, আপনি কি মনে রাখবেন আপনার ব্যাটিং বিপর্যয়ের কথা? কখনই না।  জীবন এমনই। শুধু ধৈর্য ধারণ করা শিখতে হবে। ভালো সময় আসবেই। একটা উদাহরণ দিয়েই শেষ করতে চাই, ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। বাবা ছিলেন সার্কাস দলের কর্মী। অর্থাভাবে অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করতে পারেনি। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বাস কন্ডাক্টর হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অংকে কাঁচা এই যুক্তিতে চাকরি হয়নি। পরবর্তীকালে এই জন মেজরই ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হন।যে যুবক অংকে পারদর্শী নয় বলে বাসের কন্ডাক্টর হতে পারেনি, পরবর্তী সময়ে তিনিই ব্রিটেনের মতো দেশে অর্থনীতির হাল ধরেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর পদেও অধিষ্ঠিত হন তিনি। এত এত প্রতিবন্ধকতা ছাপিয়ে যদি জন মেজর পারেন, আর আপনি প্রেম ভালোবাসার নামে প্রতারণাকারী প্রতারকদের জন্য জীবন দিয়ে দেবেন, এত সহজ নাকি আপনার জীবন? কেউ এসে ভাগ্য বদলে দেবে, এমন চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসুন। নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করুন। কেউ আপনার অপেক্ষা করেনি, করছে না এবং করবে না।লেখকঃ উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকriazul.haque02@gmail.comএইচআর/এবিএস

Advertisement