মতামত

আলোতে বসে অন্ধকারকে শক্তি জোগায় যারা

পাকিস্তানের করাচিতে প্রখ্যাত কাওয়ালী গায়ক আমজাদ সাবরিকে খুন করে দায় স্বীকার করেছে তালেবান। সারাজীবন শান্তির কথা বলে, ধর্মের গান গেয়েও এমন মত্যু হলো এই শিল্পীর। বাংলাদেশেও আজ যেখানে সেখানে নিরীহ পুরোহিত, অধ্যাপক, অহিংস লেখকদের খুন করা হচ্ছে। যা আগে কখনো হয়নি, এখন তাই হচ্ছে। আরো যেটি হচ্ছে সেটি খুব ভয়ংকর। কোনো রাখঢাক করে নয়, জোরালোভাবে সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠিগত বিরোধ ও দর্শন ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স এর একটি ছোট্ট খবরের পর যাদের শিক্ষিত, যাদের কেউ কেউ নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন, তাদের প্রতিক্রিয়া দেখলে অনুমান করতে হয় না, পরিষ্কার হয়ে যায়, কতটা মৌলবাদি এরা মনোজগতে। বিবিএস বলেছে, দেশে হিন্দু জনসংখ্যা সামান্য বেড়েছে। এটি প্রকাশের সাথে সাথেই কিছু লোক হামলে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে, সাম্প্রদায়িকতার দর্শন বমি করতে করতে বলতে শুরু করেছে ‘তবে কি এদেশে মুসলিম জনসংখ্যা নাই হয়ে যাবে’? যারা এমনটি বলছে, তারাই অধ্যাপক হত্যায়, পুরোহিত খুনে, লেখকদের চাপাতির নিচে রক্তাক্ত হওয়াকে নৈতিক সমর্থন দেয়, যদিও উপরে উপরে এরা লোকদেখানো  আহা উহু করে। চাপাতি হাতের সেই খুনিদের সাথে এদের রাজনৈতিক দর্শনের এতটুকু পার্থক্য নেই। পাকিস্তান যে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে, তার অন্যতম কারণ মৌলবাদী শক্তিকে আইনের শাসনের অধীন করতে পাকিস্তান সরকারের ব্যর্থতা। পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা বিষয়ে প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্তু তার একটি রুচিকর প্রকাশ থাকে। কিন্তু পাকিস্তানে তা হয় না। একটা খুনি মানসিকতা এদের সব প্রকাশে। ঠিক এমন একটি শক্তি বিকাশের চেষ্টা করছে বাংলাদেশে আর এদের প্রশ্রয় দিচ্ছে এসব শিক্ষিত সচেতন মানুষ। একটি বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থনতো এদের জন্য আছেই।   পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র, কারণ মৌলবাদীরা বহু কাল হতেই সেদেশের সরকার, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনীকে তাঁবেদারে পরিণত করেছে। উদার মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিতো বটেই, বহু বছর ধরে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সেনাঘাঁটি, বিমানঘাঁটি, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্র, এমনকি বাচ্চাদের স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ও তালিবান ও অন্যান্য জেহাদি জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনায় সন্ত্রাসীদের প্রতি পাকিস্তান সরকার ও একশ্রেণির ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের নরম মনোভাব বারবার উন্মেচিত হয়েছে। যারা আজ বাংলাদেশে খুনিদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সামাজিক মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ান, তারা পাকিস্তানিদের মতো সমাজ চান এখানে। এরা আপনার আমার বন্ধু হতে পারে, আশেপাশে অবস্থান করে, কিন্তু সুযোগ পেলে এরা আপনাকে খুন করবে, কিংবা আপনার ক্ষতিতে এরা ‘চিয়ার্স’ করবে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক এই জঙ্গি হামলাগুলোর প্রথম এবং প্রধান যোগসূত্র নিহিত আছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সাথে। এই বিচারের প্রক্রিয়াতেই চূড়ান্ত আক্রমণ করে মৌলবাদি জঙ্গি সাম্প্রদায়িক শক্তি। ধরা যাক ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ এর কথা৷ যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর যখন আনন্দের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শাহবাগ, ঠিক তখনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা রাস্তায় নেমে পড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য৷ জামায়াত-শিবিরের ধরিয়ে দেয়া আগুনে জ্বলল বিভিন্ন এলাকার সরকারি অফিস-আদালত৷ কোনো কারণ ছাড়াই অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হলো অমুসলিম জনগোষ্ঠী৷ ভেঙে ফেলা হলো প্রতিমা, জ্বালিয়ে দেয়া হলো মন্দির৷ পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হলো মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের ওপর৷ উপড়ে ফেলা হলো রেললাইন, পুড়িয়ে দেয়া হলো বাস-ট্রাক, ককটেল ও বোমা হামলা চলতে থাকল যানবাহনের ওপর৷ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হলো যোগাযোগ ব্যবস্থাকে৷ সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ চালানো হয় পুলিশের ওপর, থানায়৷ অস্ত্র কেড়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় পুলিশকে৷ এ অবস্থা চলে দীর্ঘকাল। এখনো চলছে, তবে ভিন্ন পদ্ধতিতে। জামায়াতে ইসলামের কর্মীরা এসব করছে। তাদের একটা রাজনীতিই আছে। কিন্তু স্যুট টাই পরা, দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ানো তথাকথিত আধুনিক মানুষ আজ সামাজিক মাধ্যমে যেসব গোষ্ঠিগত দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে দেয়ার জন্য সংখ্যালঘু বিদ্বেষী বাণী ছাড়ছেন তারা সেই হত্যা দর্শনের সবচেয়ে বড় সমর্থক। এদের মধ্যে একটি চক্র আছে, যারা বলে আমরাও মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমরাও বিচার চাই, তবে স্বচ্ছে প্রক্রিয়ায়। বুঝতে কষ্ট হয় না যে এরা মৌলবাদি অর্থে লালিত সুশীলজন।  এদের একটা ক্ষোভ আছে, যেমনটা আছে তাদের দার্শনিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের। বাংলাদেশের মানুষ যখন ধর্মীয় অন্ধতার বেড়াজাল কাটিয়ে উদার ও অসাম্প্রদয়িক পথে উন্নয়নের পথের সন্ধানে ব্যাপৃত, পাকিস্তান তখন ধর্মীয় অন্ধতার পিচ্ছিল কালিপথে হাঁটছে। দুই দেশেই গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে, তবে সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের সরকার ‘বড়’ হচ্ছে, আর পাকিস্তানের সরকার অর্থহীনতা ও পরিহাসের নামান্তর হয়ে উঠছে।  এখানেই তাদের হিংসার সূচনা। দেশ জুড়ে দিগ্বিদিকে বোমাবিস্ফোরণ আত্মঘাতী আঘাত হানার চরকিবাজিতে সহস্র মানুষের প্রাণ বিসর্জন সত্ত্বেও কোনও কার্যকরীপদক্ষেপ পাকিস্তান কখনো নেয় না। তালিবান প্রভাব কিংবা কট্টর সুন্নি জঙ্গিবাদ, কোনওটিকেই প্রতিহত করা হয়নি কখনোই। একটির পর একটি দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, বাজারহাট, স্কুলকলেজ, ব্যবসাবাণিজ্য সবই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকছে। জনতার ক্ষোভ হয়তো আছে, কিন্তু সেই ক্ষোভকে ঠিক পথে পরিচালিত করবার মতো সক্ষম রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই পাকিস্তানে। কিন্তু আছে বাংলাদেশে। অনেক ধরনের ব্যর্থতা আছে, কিন্তু এই জঙ্গি রাজনীতিকে উৎসাহ দেয়ার অঙ্গীকার নেই, তা বলা যায়। বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়। ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের হামলার ভয়ে নাগরিক সমাজ ঘরে খিল দিয়ে বসে থাকেনি। পথে নামছে, মৌলবাদিদের চ্যালেঞ্জ করছে। জেহাদি মৌলবাদে সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্র আপস ও আত্মসমর্পণের রাস্তায় হাঁটলেও বাংলাদেশের সরকার মৌলবাদি ও এদের সহযোগী বিশৃঙ্খলার শক্তিগুলিকে কড়া প্রশাসনিক দাওয়াইয়ে ব্যস্ত রেখেছে। তবে আবারো বলতে হচ্ছে কাজটি শুধু প্রশাসনিক নয়, লড়াইটা সামাজিক-সাংস্কৃতিকও। মানুষের জেগে উঠাতেই সমাধান। অন্ধকারের শক্তি অন্ধকার থেকেই কাজ করে, কিন্তু আমার আপনার পাশে থাকা অনেকে কিন্তু আলোতে বসেই অন্ধকারের শক্তিকে শক্তি আর সাহস জোগায়, কৌশল শেখায়। এইচআর/এমএস

Advertisement