দেশজুড়ে

আমাগের রক্ত দিয়ে নাকি গোসল করবে

যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাপাতলা মালোপাড়া এখন সবুজ টিন আর সাদা দেওয়ালের আধাপাকা বাড়ির এক নতুন জনপদ। সরকারের দেয়া এই বাড়িগুলোতে নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন চাপাতলার ‘মালো’রা। কিন্তু মাথার ওপরে সবুজ ছাউনি থাকলেও বুকে এখনও রক্তাক্ত ক্ষত তাদের। এ ক্ষত গত বছরের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মালোপাড়ায় চালানো তাণ্ডবে। সেই দুঃসহ নারকীয় স্মৃতিতে এখনও শিউরে উঠে রাতের ঘুম ভেঙ্গে যায় এ পাড়ার বাসিন্দাদের। বছর ঘুরে গেলেও তারা ভুলতে পারেননি সেদিনের দুঃস্বপ্নকে। বরং নতুন উৎকণ্ঠাও যেন ছায়ার মতো তাদের পিছু পিছু ফিরছে। তাই উৎকণ্ঠা জড়িত কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে মালোপাড়ার বৃদ্ধ দুলাল চন্দ্র বললেন, ‘এখন তো ভালোই আছি। কিন্তু সরকার চলে গেলি কী হবে? যারা হামলা করেছিল, তারা চারিদিকি বইলে বেড়াচ্চে সরকার চইলে গেলি আমাগের রক্ত দিয়ে নাকি চাঁঁন (গোসল) করবে।’দুলাল চন্দ্রের মতো এমন আতঙ্ক জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় নির্বাচনোত্তর সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের শিকার সকলের। এ পাড়ার বাসিন্দা শেখর চন্দ্র জানান, গ্রামের শিশু ও মহিলারা সেদিনের সেই দুঃসহ্য স্মৃতি একেবারেই ভুলতে পারছে না। এখনও কোথায় পটকা বা আতশবাজির শব্দ শুনলে আঁতকে ওঠে। বড়দের জড়িয়ে ধরে বলে, ওই তারা (হামলাকারিরা) আসছে! সারাদেশে বছরজুড়ে ঘটে যাওয়া আলোচিত ঘটনার অন্যতম ছিল চাপাতলা মালোপাড়ার এই সহিংস ঘটনাটি। এমনিতেই চাঁপাতলার মালোপাড়ার চেহারা মানিক বন্দ্যোপধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের ‘কুবের মাঝি’র মালোপাড়া থেকে ভিন্ন। এখানকার বেশিরভাগ মালোই অপেক্ষাকৃত অবস্থাসম্পন্ন। কাজ করেন ‘ঘের-দড়ি’র। মাছ ধরেন নদীতে। ছেলেমেয়েদের পড়ান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদের অনেকেরই বসতবাড়িতে ছিল ইটের ছোঁয়া। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ায় কয়েকশ’ অস্ত্রধারী অতর্কিত হামলা চালায় মালোপাড়ায়। হামলাকারিরা ২০/২৫টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি ছাড়াও শতাধিক বাড়িঘরে ভাঙচুর এবং ঘরে থাকা মালামাল লুটপাট করে। পুড়িয়ে দেয় ১০টি বাড়ি। হামলায় আহত অন্তত ২৫ জন। এসময় আতঙ্কিত গ্রামবাসি পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদ সাঁতরে ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে পার হয়ে দেয়াপাড়া গ্রামের পালপাড়া এলাকার পূজামণ্ডপে আশ্রয় নেন। পরদিন প্রশাসন ও রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃবৃন্দর সহায়তায় গ্রামে ফেরেন তারা। জামায়াত-বিএনপি’র চালানো সেদিনের ওই সহিংসতায় তছনছ হয়েছিল পুরো গ্রাম।বর্তমানে সে অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। ঘটনার পর চাল, ডাল, কম্বল, জাল, নগদটাকা সবকিছুই পেয়েছেন পর্যাপ্ত। লেগেছে বিদ্যুৎ সংযোগ। ক্ষতিগ্রস্ত ৬২টি পরিবারকেই সরকারের পক্ষ থেকে পাকাবাড়ি করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি সংস্কার করে দেয়া হয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে নির্মিত নতুনবাড়ির পাশাপাশি রয়েছে সংস্কার করা বাড়িও। মালোপাড়া এখন তাই সবুজ টিন আর সাদা দেওয়ালের এক নতুন জনপদ। হামলার পর দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পাশে দাঁড়ায় তাদের। ছুটে আসেন দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, মন্ত্রী-এমপি, দেশি-বিদেশি সংস্থা ছাড়াও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সহিংসতার শিকার মালোপাড়ার মানুষ গত একবছরে পেয়েছেন পাকারাস্তা, নতুন ঘরবাড়ি ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি অনেক সাহায্য সহযোগিতা। গ্রামে বসানো অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা এখনও পাহারা দিচ্ছেন মালোপাড়া। এতে খুশি সেখানকার মানুষেরা। কিন্তু ঘটনার একবছর পেরিয়ে গেলেও পাননি শুধু সহিংসতায় জড়িতদের বিচার। হামলার ঘটনায় ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে দু’টি মামলা হলেও বেশিরভাগ আসামিই এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকাশ্যে। ফলে আতঙ্ক কাটছেনা এখানকার বাসিন্দাদের।আলাপকালে বিশ্বজিৎ সরকার, কঙ্করী সরকার, প্রহ্লাদ বর্মনসহ এখানকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, হামলাকারিরা নানা হুমকি-ধামকি এখনও অব্যাহত রেখেছে। ফলে সবসময় ভীতির মধ্যে থাকেন গ্রামের মানুষ। এই ভীতি কাটাতে হলে মামলার আসামিদের দ্রুত আটক ও বিচার করাসহ গ্রামে বসানো পুলিশ ক্যাম্পটি স্থায়ী করতে হবে। অনেকটা জোর দিয়ে বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, আমরা সব পাইছি। এখন শুধু বিচার পেলেই খুশি। এদিকে যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান জানান, মালোপাড়ায় হামলার সঙ্গে জড়িত প্রধান খলনায়কেরা ইতিমধ্যে আটক হয়েছে। দু’একজন জামিনে বের হলেও বেশিরভাগ আসামি কারাগারে। বাকি যারা বাইরে আছে তাদেরকে ধরতে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। বর্তমানে এ এলাকায় কোন ভীতি নেই উল্লেখ করে তিনি জানান, মালোপাড়ায় পুরোপুরি স্বস্তি ফিরেছে। আর মামলা দু’টি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে। খুব শিগগির মামলার চার্জশিট দাখিলের সম্ভবনা রয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন।

Advertisement