খেলাধুলা

আবাহনীর চ্যাম্পিয়নশিপে যেন চাঁদের কলঙ্ক

কথায় বলে ‘চাঁদেরও নাকি কলঙ্ক আছে!’ এমন যে সুন্দর চাঁদ, যার মোহনীয় রূপ আর স্নিগ্ধ আলো মন কেড়ে নেয়- তার আবার কলঙ্ক কিসের? প্রশ্ন জাগে বৈকি; কিন্তু কেউ তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন না। কারণ ওটা প্রবচন। যার সত্যতা ছাপিয়ে ভাবটা মূখ্য। চাঁদের কলঙ্ক বলতে আসলে বোঝানো হয় তাবৎ সৌন্দর্য্যরে মাঝেও কিছু কালো দাগ থাকে। ভালোর ভেতরেও থাকে মন্দ। এবারের ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট নিয়ে লিখতে বসে আমার সেই চিরচেনা- জানা প্রবচনটিই মনে পড়ল। নিকট প্রতিদ্বৎন্দ্বীদের পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত লিগ শিরোপা জিতল আবাহনীই। অতিবড় সমালোচকও মানছেন মাঠের জমজমাট লড়াই শেষে যোগ্যতর দলই হয়েছে চ্যাম্পিয়ন। সেরা দলই হেসেছে শেষ হাসি। আসুন দেখে নেই আবাহনী কিভাবে সেরা দল হিসেবে লিগ জিতলো। প্রথম কথা, প্লেয়ার্স বাই চয়েজের দলবদলের পর আবাহনীকেই এক নম্বর দল বলে ভাবা হচ্ছিল। তামিমের মত দেশ সেরা ওপেনার, লিটন দাসের মত ফ্রি স্ট্রোক খেলার সহজাত প্রতিভা, সম্ভাবনাময় মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, নাজমুল হোসেন শান্তর মত ব্যাটসম্যান, তাসকিন, আবুল হাসান রাজুর মত ফাস্ট বোলার, সাকলাইন সজিব ও জুবায়ের হোসেন লিখনের মত স্পিনারে গড়া দলতো কাগজে কলমে সবার সেরাই। তবে শুরুতে কিছু নির্ভরযোগ্য পারফরমার জ্বলে উঠতে না পারায় সমস্যা হয়েছে। তবে যত সময় গড়িয়েছে, সে সব ক্রিকেটাররা ততই নিজেদের ফিরে পেয়েছেন। কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সঙ্গে প্রথম খেলায় ৭  উইকেটের জয়ে শুরু। দ্বিতীয় খেলাতেই শেখ জামালের সঙ্গে ২৮৭ রানের বড় স্কোর গড়েও ৪ উইকেটে হার। তারপর ব্রাদার্স (২ উইকেটে), ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে (৯ রানে) পরপর দুই ম্যাচ কষ্টের জয়। এরপর হঠাৎ ছন্দপতন। রূপগঞ্জ (৫ উইকেট), মোহামেডান (৮ উইকেটে) ও কলাবাগান ক্রিকেট একাডেমির কাছে (২৮২ করে ৩ উইকেটে পরাজয় ) টানা তিন ম্যাচ হেরে বসা। এখানেই পিছিয়ে পড়ে। যে কারণে পয়েন্টে চির প্রতিদ্ব›দ্বী মোহামেডান, লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ ও প্রাইম দোলেশ্বরের সমান ১৪ পয়েন্ট নিয়ে সুপার লিগে উঠলেও নেট রানরেটে অবস্থান দাড়ায় চার নম্বরে। সেখান থেকে সুপার লিগে উঠে চ্যাম্পিয়ন। সহজ ছিল না মোটেই। তামিম, লিটন দাস, মোসাদ্দেক সৈকত, সাকিব, সাকলাইন সজিব ও তাসকিন সময়মত জ্বলে উঠে সে অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন। তাদের নৈপুণ্যের দ্যুতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেনি লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ, প্রাইম দোলেশ্বর, ভিক্টোরিয়া, মোহামেডান ও প্রাইম ব্যাংক। সুপার লিগে প্রথম ম্যাচে ব্যাটিং বিপর্যয়। বিকেএসপিতে প্রাইম দোলেশ্বরের সাথে ১৯১ তে অলআউট। জবাবে প্রাইম দোলেশ্বর ২/৫৯ থাকা অবস্থায় ম্যাচ পণ্ড। তারপর যেন জাদুর চেরাগের স্পর্শে বদলে যায় আবাহনী। পরের চার খেলায় আকাশী-হলুদ জার্সিধারীরা দূর্বার, দুর্দমনীয়। সুপার লিগের চার ম্যাচে তামিম বাহিনীর দোর্দণ্ড প্রতাপে একে একে অসহায় আত্মসমর্পন মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, রূপগঞ্জ ও প্রাইম ব্যাংকের। মোহামেডানের সঙ্গে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে ২৬০ রানের ব্যবধানে বিশাল জয়। যা বাংলাদেশের  লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে সর্বাধিক দলগত স্কোর ও সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়। ধারণা করা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে ৫০ ওভারের লিগেরও সর্বাধিক স্কোর এটি। তারপর একে একে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে ৬ উইকেট, লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জকে ৬০ রানে ও প্রাইম ব্যাংককে ১১৫ রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন আবাহনী। আগেই বলা হয়েছে, আবাহনী সুপার লিগে খেলেছে চ্যাম্পিয়নের মতই। ভারতের আইপিএল খেলে এসে সাকিব দলে যোগ দেয়ার পর আবাহনীর ব্যাটিং ও বোলিং শক্তি বেড়ে যায় বহুগুণে। দুই তরুণ মোসাদ্দেক ও নাজমুল হোসেন শান্ত, বিশেষ করে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত শেষ দিকে দারুণভাবে জ্বলে উঠলে আবাহনীর ব্যাটিং শক্তি বেড়ে যায় বহুগুণে। মোদ্দা কথা দেরিতে নিজেদের ফিরে পাওয়া আবাহনী ক্রিকেটাররা শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং ও বোলিংয়ে নিজেদের সেরার প্রমাণ দিয়েছেন। অধিনায়ক তামিম ইকবাল সে সাফল্যের মিশনে একদম সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দুই সেঞ্চুরিতে সাজানো ৭১৪ রান করে রান তোলায় দ্বিতীয় স্থানটি আবাহনী অধিনায়কের। রান তোলায় সেরা ছয়ে আছেন তরুণ মোসাদ্দেক সৈকতও (৬২২ রান)। সঙ্গে  ১১টি উইকেটও পেয়েছেন এ প্রতিভাবান ক্রিকেটার। রূপগঞ্জের বিরুদ্ধে সুপার লিগে এ ৫ উইকেট ও ৭৩ রানের দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরমেন্স করেছেন সৈকত। মোহামেডানের সাথে ২২বলে হাফ সেঞ্চুরি হাঁকানোর পাশাপাশি ৫ উইকেট শিকারী সাকিবও। রান তোলায় ১২ নম্বরে আবাহনীর নাজমুল হোসেন শান্ত (৫৩৭)। মোহামেডানের সাথে ১৪৮ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলা লিটন দাসও শেষ পর্যন্ত কম যাননি। ৪০৪ রান করেছেন। উইকেট শিকারেও আবাহনীর বোলাররা সামনের সারিতে। প্রথম তিনজনের দুজনই আবাহনীর বাঁহাতি স্পিনার সাকলাইন সজিব ও ফাস্ট বোলার তাসকিন ২৬টি করে উইকেট পেয়ে যৌথভাবে তৃতীয় সর্বাধিক উইকেট শিকারি। মাত্র ৮  খেলায় সাকিব আল হাসানের ঝুলিতে জমা পড়েছে ১৮ উইকেট। এতগুলো পারফরমারের এমন নজরকাড়া পারফরমেন্সের ফসলই আবাহনীর শিরোপা। তারপরও আকাশী-হলুদ শিবিরের এ সাফল্যর বন্দনা- স্তুতির পাশাপাশি আছে সমালোচনা। অভিযোগ। তার ভিত্তি কতটা? তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে; কিন্তু সমালোচনা ও অভিযোগের কমতি নেই। আর তাই তো লিগ চ্যাম্পিয়ন হবার পরও অধিনায়ক তামিম ইকবালের কন্ঠে এমন কথা, ‘সমালোচনা অনেক বেশি হয়েছে। খারাপ আলোচনার ভীড়ে আমাদের ভালোটা হারিয়ে গেছে।’ এখন খুঁটিয়ে দেখতে হবে সত্যিই আবাহনীর সাফল্যে কোন কালো দাগ আছে কি না? দাগ বলতে ওই যে বলা হলো সমালোচনা ও অভিযোগ, তা আছে। তা কেমন? শুনুন তাহলে,  প্রতিপক্ষ দলের কর্তাদের অভিযোগ, আবাহনীর কর্মকর্তারা বোর্ডের প্রভাবশালী কর্তা। তারা নিজেদের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি সুবিধা নিয়েছেন। শের-ই বাংলা ও ফতুল্লায় ফল ভাল না হওয়ায় বিকেএসপিতে বেশি ম্যাচ খেলেছে। মান সম্পন্ন অভিজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি আম্পায়ারদের বাইরে রেখে তূলনামুলক লো-প্রোফাইল আম্পায়ারদের বেশিরভাগ খেলা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। যারা কৃতজ্ঞতা বশতঃ আবাহনীর পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। প্রথম লিগে ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলি স্টেডিয়ামে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে ম্যাচের আম্পায়ারিং নিয়ে ভিক্টোরিয়া শিবির প্রকাশ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে, আম্পায়াররা বাজে লেগবিফোর উইকেটের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তারপরও অমন অভিযোগ শোনা গেছে। আম্পায়ারিংয়ের পাশাপাশি আবাহনীর বিকেএসপিতে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা নিয়ে বিস্তর কথা হয়েছে। প্রথম পর্ব ও সুপার লিগ মিলে আবাহনী সর্বাধিক আটটি ম্যাচ খেলেছে বিকেএসপিতে। তিন-তিনটি ভেন্যু থাকার পরও একটি দলের এতগুলো খেলা বিকেএসপিতে কেন? তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অবান্তর নয়। অভিযোগ- বিকেএসপিতে মিডিয়া কম যায়, সেখানে আম্পায়ারা আবাহনীকে ফেবার করলে তা জনসম্মুখে আসবে কম। তাই আবাহনী বেশি ম্যাচ বিকেএসপিতে খেলেছে। এ অভিযোগের সত্যিকার সত্য কতটা? তা অভিযোগকারী ক্লাব কর্তারাই ভাল বলতে পারবেন। তবে একটা মাঠে বেশি খেলায় আবাহনী একটা অন্যরকম সুবিধা পেয়েছে। উইকেট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা জন্মেছে। ক্রিকেটাররা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে ভাল খেলতেও পেরেছেন। খালেদ মাহমুদ সুজনের মত অভিজ্ঞ ও ঝানু নেপথ্য কারিগর নিশ্চয়ই বিকেএসপির উইকেটের চরিত্র ও গতি- প্রকৃতি বুঝে দল সাজিয়েছেন। চেনা-জানা পরিবেশ ও ধারনা হয়ে যাওয়া উইকেটে লক্ষ্য-পরিকল্পনা আঁটা এবং কৌশল নির্ধারণেও সুবিধা হয়েছে বেশি। আইএইচএস/পিআর

Advertisement