জাগো জবস

আমরাই গণমাধ্যম পেশায় পরিবর্তন আনবো : আদেল

রাফে সাদনান আদেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স করেছেন। তিনি সাংবাদিকতার বর্ণাঢ্য জীবনে গত এক দশকে রেডিও, টেলিভিশন, অনলাইন ও ইংরেজি দৈনিকে কাজ করেছেন। এমনকি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগে ‘অতিথি প্রভাষক’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি একুশে টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন।গণমাধ্যমের প্রায় সব নতুন উদ্যোগের সাথে থাকা পরিশ্রমী এই মানুষটি ক্যারিয়ারের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন জাগো জবসের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোলাম রাব্বী।জাগো জবস : শুরুতেই আপনার পড়াশোনা বিষয়ে চানতে চাই-রাফে সাদনান আদেল : এসএসসি ও এইচএসসিতে আমার পড়াশোনার বিষয় ছিল বিজ্ঞান। একটা সময় ছিল যখন আমার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবার প্রবল ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানেই পড়ালেখা শুরু করি। পড়ালেখায় খুব একটা মনোযোগ না থাকায় খুব বেগ পেতে হয়েছে। পড়ালেখায় খুব একটা মনোযোগ না থাকায় খুব বেগ পেতে হয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই ক্রিয়েটিভ এবং মিডিয়া রিলেটেড কাজে খুব বেশি জড়িত থাকায় শেষাবধি কোনো রকমে পড়ালেখা শেষ করতে পেরেছি। জাগো জবস : আপনার কাজ শুরুর অভিজ্ঞতাটা যদি বলতেন-রাফে সাদনান আদেল : তখন দ্বিতীয় বর্ষের একেবারে শেষদিকে, হঠাৎই পত্রিকায় দেখলাম একটি এফএম রেডিও আসবে। সিভি দিলাম। কয়েক দফা পরীক্ষাও হলো, লিখিত তারপর ভয়েস টেস্ট আবার ভাইভা। রেডিও জকি হয়েই গেছি এমন ভাব-চক্করে ঢুকে পড়লাম এবিসি রেডিওতে। তবে ঠাঁই মিলল আউট ডোর ব্রডকাস্টারের তালিকায়। মনটা একটু খারাপ হলেও শুরু হলো সেখানেই। এরপর ছোটখাটো অ্যাসাইনমেন্ট করা আর তারই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকতার প্রেমে পড়ে যাওয়া।জাগো জবস : আপনি অনলাইন মিডিয়ার সাথেও জড়িত ছিলেন-রাফে সাদনান আদেল : এবিসি রেডিও ছেড়ে দিতে হয় বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের ‘বিবিসি জানালা’য় ইন্টার্নশিপ পাওয়ার পর। এরপর হঠাৎই একসময়ের বিবিসি’র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট ফরিদ ভাই জানালেন, দেশের একটি কোম্পানি অনলাইন পত্রিকা করতে যাচ্ছে। অগত্যা নতুন কিছুর লোভ আমার এবং বরাবরের মতো বাংলানিউজ টোয়েন্টেফোর ডটকমে যোগ দিলাম। শুরুর ভিতটা গড়তে রাতদিন পরিশ্রম করলাম সবাই মিলে। আলমগীর ভাইয়ের নেতৃত্বে শিখলাম অনেক কিছু। পরবর্তীতে যা কাজে লেগেছে পত্রিকায়। যদিও এরপর আমি টেলিভিশনের দিকে ছুট দেই।জাগো জবস : আপনি ২৪ ঘণ্টার সংবাদমাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন কেন?রাফে সাদনান আদেল : সিএসবি’র শূন্যতা পূরণে এটিএন নিউজ যখন বাজারে তখন মুন্নীদি (মুন্নী সাহা) লোক খুঁজছেন শুনেই দৌড় দিলাম; এবার তবে শিখবো ব্রডকাস্ট জার্নালিজম। সব মিলে গেল ব্যাটে-বলে। তাই শুরু হলো সরাসরি সম্প্রচার আর কথার সাথে ফুটেজের মিশেল দিয়ে সাংবাদিকতার পাঠ। সেখানে মিশুক মুনীর স্যারের সান্নিধ্য এক পরম পাওয়া (না উল্লেখ করলেই নয়)। সে সময় আমার বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা দেখা বেড়ে গেল। ইচড়েপাঁকার মতো ব্লগে ধুঁয়ে দিতে শুরু করলাম গণমাধ্যমের প্রচার নীতিকে। আর সেকারণেই প্রযুক্তির ক্ষুধাটা আরও বাড়তে লাগলো। যার খানিকটা কমতি ছিল এটিএন নিউজে। এরপর সময় আর একাত্তর টিভিতে কাজ করে অবশ্য তা পুষিয়ে গেছে। তারও চেয়ে বেশি যেটা শেখা হয়েছে তা হলো নতুন করে একটা টিম কীভাবে একটা টেলিভিশন দাঁড় করিয়ে ফেলে মুহূর্তে। কীভাবে প্রতিটি সেকশনের মেলবন্ধন হয় সুনিপুণ দক্ষতায়। এরপর চ্যানেল২৪ এ এসে শিখেছি ছকে ফেলা ছন্দ কাকে বলে। বিশ্বাস করুন প্রায় প্রতিটি চ্যানেলই সফলতা পাচ্ছে নবীন সাংবাদিকদের উপর আস্থা রেখেই কিন্তু প্রায় প্রতিটি হাউজেই তারা চরম অবহেলিত।  জাগো জবস : আপনি বরাবরই নবীনদের পক্ষে সোচ্চার কেন?রাফে সাদনান আদেল : ওই যে বলছিলাম, নবীনরাই প্রতিটি চ্যানেলের প্রাণ; কিন্তু পাওয়ার তালিকায় বরাবরই অবহেলিত। তাদের হয়ে কথা বলারও কিছু নেই। সবাই দেখান সফলদেরই। কিন্তু ওই বৈষম্যে কতো মেধাবী ড্রপ আউটি হচ্ছেন তার হিসেব কেউ রাখছেন না। খেয়াল করে দেখুন ইতিহাস গড়ে দেয়া গণমাধ্যমগুলোর প্রত্যেকটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে নতুনদের একাগ্রতা আর পরিশ্রমে; কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখুন তাদের মূল্যায়ন, ন্যাক্কারজনক। মাতৃত্বকালীন ছুটি মেলে না; এমন নজিরও আছে এই দেশে। তবুও আমি আশাবাদী একজন। জাগো জবস : হঠাৎ টেলিভিশন ছেড়ে আপনি সংবাদপত্রে চলে গেলেন-রাফে সাদনান আদেল : সব ধরনের গণমাধ্যমে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিজের ঝুলিতে পুরতেই আসলে ঢাকা ট্রিবিউনে যোগ দেয়া। পরে অবশ্য তাদের আয়তন ছোট করে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পারায় সেখান থেকে সরে আসা। জাগো জবস : এরপর তো আপনি স্পোর্টস বেইজড অনলাইন গড়লেন-রাফে সাদনান আদেল : সব মাধ্যমে কাজ করার পর একটু হতাশ হয়ে পরেছিলাম, পরে ভাবলাম এবার নিজের কিছু করবো নিজের মতো করে। দেশের অগণিত ক্রীড়ামোদি মানুষের তথ্যক্ষুধা মেটাতে সেই উদ্যোগ দারুন প্রশংসা কুড়িয়েছিল। আর্থিক টানাপোড়েনে সেটিও এগোয়নি। কিন্তু এখনোও সেই ইউনিক উদ্যোগটা বড় কোনো বিনিয়োগকারীর হাতের ছোঁয়া পায়নি। পেলে কিন্তু নির্দ্বিধায় সেখানে অভাবনীয় সাফল্যের সম্ভাবনা রয়েছে। জাগো জবস : এরপর আবারো ফিরলেন টেলিভিশনে, স্থিরতা নেই কেন?রাফে সাদনান আদেল : টেলিভিশনে ফিরেছি আসলে অনুরোধে। একুশে টেলিভিশন নতুন করে আবারো ঘুড়ে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে যখন শুরু করলো, এই বছরের শুরুতে তখনই যোগ দিলাম। ওই যে নতুনকে স্বাগত জানানো। আর হ্যাঁ- স্থিরতা নেই, এই অভিযোগ আসলে সবার। কিন্তু আমার যে সাংবাদিকতার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই, তাই ঘুরে ঘুরেই শিখতে হচ্ছে! জাগো জবস : একসময় তো আপনি সংবাদও উপস্থাপনা করতেন?রাফে সাদনান আদেল : রিপোর্টিংয়ের পাশাপাশি সংবাদ পড়তাম সময় টেলিভিশনে থাকতে। কিন্তু সেটা রিপোটিংয়ের একাগ্রতায় ছেদ টানতো সবসময়। আর সেকারণেই সেটা থেকে দূরে সরে আসা। তবে বুড়ো বয়সে আবারো এই পরিচয়ে স্ক্রিনে আসার ইচ্ছে আছে, যখন চেহারার সৌন্দর্যে নয় ব্যক্তিত্বের ভারিক্কিতে গ্রহণযোগ্যতা মিলবে দর্শকের কাছে।জাগো জবস : এই পথপরিক্রমায় কোন অভিজ্ঞতা আপনাকে ভাবায়?রাফে সাদনান আদেল : বিডিআর বিদ্রোহ, রানা প্লাজা ধস, হেফাজত তাণ্ডব- কী না করা হলো এই এক দশকের সাংবাদিকতায়! কৃতজ্ঞতা তো বটেই! অভিজ্ঞতার এই ঝুলি ভারি হয়ে গেলেও মনটায় শান্তি মেলে না, যখন দেখি এতো ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা পেশায় কাজ করেও আমরা বঞ্চিত হই স্বাভাবিক মজুরি আর সুযোগ-সুবিধা থেকে। এসবই ভাবায় আসলে। তবে আমি আশাবাদী এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবেই। পেশাদারীত্ব আসবেই। আমরাই গণমাধ্যম পেশায় পরিবর্তন আনবো। একদিন বিনিয়োগকারীরাও বুঝবেন যে ঘুণে ধরা পুরোনো বটগাছের চেয়ে বেড়ে ওঠা নতুন গাছ তার সবুজেই হয় প্রাণের বিপ্লব। আমার বিশ্বাস, আমরাও একদিন সুযোগ পাবো নতুন কিছু করে দেখানোর, যেই নবীনে ভর করে বিকশিত হচ্ছে গণমাধ্যম, তার হাল ধরার সুযোগ আসবেই। জাগো জবস : আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই তৎপর কেন?রাফে সাদনান আদেল : সাংবাদিকতায় নেটওয়ার্কের কোনো বিকল্প নেই। আর সোশ্যাল মিডিয়া আপনাকে সেই সুযোগ করে দিচ্ছে, তো- কেন হারাবেন। আপনি হয়তো অনেককে ফোনে পাবেন না, মাসে একবারও দেখা হবে না। কিন্তু তার প্রতিটি মুহূর্ত আপনি ট্রেক করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়; প্রয়োজনে হচ্ছে যোগাযোগ; এই সুযোগ হারাতে নারাজ আমি। জাগো জবস : এ প্রফেশনে আয়-সুযোগ-সুবিধা কেমন?রাফে সাদনান আদেল : আর দশটা চাকরির চেয়ে একটু আলাদা। এই মাধ্যমের শীর্ষে পৌঁছলে দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করাও অসাধ্য নয়। চাই একাগ্রতা আর সততা। শুধু চাকরির পাশাপাশি আরো অনেক সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এখনো কর্পোরেট দুনিয়ার কল্যাণে। কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তবেই সম্ভব।জাগো জবস : যারা রেডিও-টিভিতে আসতে চান, তাদের জন্য পরামর্শ-রাফে সাদনান আদেল : প্রচুর পড়তে হবে। যা পান সামনে তাই পড়তে হবে আগ্রহের সাথে। দারুণ সন্দেহবাতিক হতে হবে যদি সাংবাদিকতায় আসতে চান। আর পরিশ্রম আর সততার কোনো বিকল্প নাই এই পেশায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজেকে তুলে ধরার গুণটা রপ্ত করতে হবে। থাকতে হবে পরিছন্ন কী পোশাকে কী ব্যবহারে। তবেই সম্ভব। টেলিভিশন-রেডিওর সাথে যুক্ত হওয়া হাতি-ঘোড়া কিছু নয়।জাগো জবস : ক্যারিয়ার নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ ভাবনা-রাফে সাদনান আদেল : আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থেই একেবারে সবগুলো গণমাধ্যমের পালস বোঝা কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট নেই। সেই সাথে নেই একটা পেশাদারীত্বপূর্ণ মিডিয়া লিমিটেড। আমার স্বপ্ন আমার টার্গেট নিজেকে আর্ন্তজাতিক মানের একজন কমিউনিকেশন স্পেশালিস্টের জায়গায় নিয়ে যাওয়া। জাগো জবস : আপনার কাছে ‘সফলতা’র সংজ্ঞা-রাফে সাদনান আদেল : পরিশ্রম, সততা, অধ্যবসায়ের সাথে দরকার ধৈর্য। তাহলেই সম্ভব সফলতার দেখা পাওয়া। আমার অন্তত বিশ্বাসটা এমনই। যদিও নিজেকে এখনো সফল মনে করি না। স্বপ্নের মতো একটা পেশাদারিত্বপূর্ণ মিডিয়া গ্রুপ গড়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গী হবার পরই তা মনে করবো। জাগো জবস : ক্যারিয়ারে সফলতা নিয়ে আপনার কোনো পরামর্শ-রাফে সাদনান আদেল : ফোকাস ঠিক করতে হবে সবার আগে, তারপর ধৈর্য ঠিক রেখে লড়ে যেতে হবে। ইগোকে পকেটে পুরে শিখতে থাকতে হবে প্রতিনিয়ত। একটা সময় সফলতা ধারাবাহিকভাবে ধরা দিতে শুরু করবে বলেই আমার বিশ্বাস।জাগো জবস : সাংবাদিকতার পাশাপাশি আর কিছু কি করেন?রাফে সাদনান আদেল: আমার মা দীর্ঘ আড়াই বছর ক্যান্সারের সাথে লড়ে দু’বছর আগে ইন্তেকাল করেন। মা এই জটিল রোগে আক্রান্ত হবার পর থেকেই আমি নানাভাবে ক্যান্সার সচেতনতায় কাজ করছি। ক্যান্সার সচেতনতায় বহুভাষায় ‘ক্যান্সারবিডি’ শীর্ষক একটি ওয়েবসাইটের পুনর্বিন্যাসের কাজও চলছে। এই ওয়েবসাইটটিতে ক্যান্সারের সব ধরনের তথ্য তো থাকবেই, সেই সাথে থাকবে তাৎক্ষণিক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা।জাগো জবস : আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।রাফে সাদনান আদেল: আপনাকে ও জাগো জবসকে অনেক ধন্যবাদ।এসইউ/পিআর

Advertisement