বিশেষ প্রতিবেদন

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুর্নীতির বোঝা জনগণের কাঁধে

একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম, আর্থিক কেলেঙ্কারি আর চরম অব্যবস্থাপনায় নাজেহাল দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। দিন যতই যাচ্ছে, ততই মূলধন ঘাটতির পাশাপাশি বাড়ছে খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি (নিরাপত্তা সঞ্চিতি)। এসব অনিয়ম রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের নানা পদক্ষেপও তেমন কোনো কাজে আসছে না। আর এ পরিস্থিতিতে জনগণের করের টাকায় এবারো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অদক্ষতা ও দুর্নীতির দায় মেটাতে প্রস্তাবিত বাজেটে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার। জনগণের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংক হলেও এখন তা সাধারণের কাঁধের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সরকারের এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, আর্থিক কেলেঙ্কারি, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপানার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ হচ্ছে। এই বিশাল অর্থ উদ্ধারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো জনগণের করের টাকায় এ ঘাটতি মেটাতে যাচ্ছে সরকার। এদিকে, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তখন এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয় বলে মত দিয়েছেন ব্যাংকিং খাতের পর্যবেক্ষকরা। এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের উচিত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ না দিয়ে তাদের দক্ষতা ও খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে যারা ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া।  তিনি আরো বলেন, এভাবে মূলধনের ঘাটতি মেটাতে সরকার অর্থ দিলে তারা কাজ না করে টাকা নিতে উৎসাহী হবে। আর সরকারের অর্থ মানে সাধারণ জনগণের উপর দায় চাপানো। তাই আগামীতে যাতে জনগণের করের অর্থ বরাদ্দ দিতে না হয় সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আগামী (২০১৬-১৭) অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি সর্বশেষ (জানুয়ারি-মার্চ-২০১৬) হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ খেলাপি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ২৮৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চের শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর সমন্বিত মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকায়। মূলধন ঘাটতিতে থাকা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো হচ্ছে- সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সর্বাধিক দুই হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের ৪৪৪ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের দুই হাজার ২৩৬ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সাত হাজার ২৫ কোটি টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ৭৮৯ কোটি টাকা। তবে গত ডিসেম্বরে ৪৯ কোটি টাকা ঘাটতিতে থাকা জনতা ব্যাংক এখন ৪৮ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত রয়েছে। জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটাতে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার, যা ব্যাংক ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা এবং দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। সালেহ উদ্দিন বলেন, সরকারি টাকা দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে মূলধন সরবরাহ করা উচিত নয়। মূলধন ঘটতি মেটাতে খেলাপি ঋণ আদায়ে মনোযোগ দিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যর্থ হলে এসব ব্যাংকের কার্যক্রম সংকুচিত করে সরকারি অর্থ অপচয় রোধ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন সাবেক এ গভর্নর। এদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীর। সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠকে খেলাপি ঋণ কীভাবে কমানো যায়, সে বিষয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে আরো সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন গভর্নর।   উল্লেখ্য, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংকে টানা দুই বছর মূলধন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এছাড়া ঘাটতির এক বছর পর থেকে জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তি কার্যকরের বিধান রয়েছে। এসআই/এমএমজেড/এএইচ/পিআর

Advertisement