ফিচার

একজন সহজ-সরল মানুষ

পড়াশোনার হাতেখড়ি যার কাছে; তিনিই তো প্রথম শিক্ষক। সেক্ষেত্রে বাবাই আমার প্রথম শিক্ষক। বাবা চিৎ হয়ে শুয়ে বুকের ওপর বসিয়ে ‘আয় আয় চাঁদ মামা’ ছড়া শিখিয়েছেন। তাছাড়া আমার বাবা পেশায় একজন শিক্ষক। প্রাথমিক শিক্ষাজীবনে বাড়ির পড়া তার কাছেই তৈরি করেছি। বাবা সুন্দর করে বইতে মলাট লাগিয়ে তার ওপর আমার নাম, শ্রেণি ও রোল নম্বর ইত্যাদি লিখে দিতেন। হাতের লেখা সুন্দর করার কৌশল তিনিই আমাকে শিখিয়েছেন।প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে যখন মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই; বাবা সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। বাবার দরাজ কণ্ঠের ভাষণ আমাকে মুগ্ধ করতো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাকে বাবাকে সুদর্শন লাগতো। আমার বন্ধুরা দুষ্টুমি করে বলতো, ‘তাকে ক্লাসে বাবা বলতে পারবি না। স্যার বলে ডাকবি।’ আমি মুচকি হাসতাম।বাবা ক্লাসে আসলে আমি ভয়ে তটস্থ থাকতাম। যদি পড়া ঠিকঠাক না পাড়ি। তাহলে বাড়ি গেলে বকবেন। বাবার পড়াটা তৈরি না করে কখনো ক্লাসে আসতাম না। আমি একজন শিক্ষকের আদর্শ ও নৈতিকতা আমার বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি। সমগ্র শিক্ষাজীবনে যত শিক্ষক পেয়েছি, সবাই আমার প্রিয় বা আমিও তাদের প্রিয় ছাত্র ছিলাম। তবে বাবা আমার কাছে শিক্ষক হিসেবে অধিক প্রিয়। আমি আসলে গর্বিত। কারণ, একজনের মধ্যে দু’টি গুণ খুঁজে পেয়েছি। এক. আদর্শ শিক্ষক দুই. আদর্শ বাবা।২.বাবাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবো ভাবছি। কারণ বাবা আমার একনিষ্ঠ পাঠক। আমার প্রায় সব লেখাই তিনি পড়েছেন। জানি না উপন্যাসটি তিনি পড়ে যেতে পারবেন কিনা?ছেলেবেলায় বাবাকে খুব ভয় পেতাম। যৌবনে এসে সেই বাবার সাথেই হয়ে গেল গাঢ় বন্ধুত্ব। অনেক কিছুই এখন বাবার সাথে শেয়ার করি। খোলামেলা আলোচনা করি। কখনো রেগে ওঠেন না। তার এক কথা, ‘তোমার যা ভালো মনে হয়, তা-ই করো। এখন তুমি বুঝতে শিখেছো।’যেহেতু বাবা আমার মাধ্যমিক জীবনের শিক্ষক ছিলেন; সেহেতু শ্রেণিকক্ষে তার দরাজ কণ্ঠের পাঠদান আর ভরাট গলার ধমক এখনো চমকিত করে আমাকে। আমি বাবার শরীর ও কণ্ঠ দু’টোই পেয়েছি। আমরা দু’জনই ছিপছিপে শরীরের। তবে কণ্ঠে অনেক জোর।পার্থক্য এতটুকু- বাবা কোরআন-হাদিসের কথা বলেন আর আমি আবৃত্তি ও অভিনয় করি। তাতে বাবার প্রকাশ্য সম্মতি না থাকলেও কখনো নিষেধ করেননি। আমাকে নিয়ে কেউ তাকে উস্কানি দেয়, কেউ আবার প্রশংসা করেন। বাবা চুপচাপ শোনেন। প্রত্যুত্তর করেন না।৩.আমার বাবা একজন সহজ-সরল মানুষ। সারল্য তাকে ঠকিয়েছে। পিতৃবিয়োগে দিশেহারা মানুষটি আগলে রেখেছিলো ১১ জনের বৃহৎ সংসার। পাখির ছানার মতো সবাই আশ্রয় নিয়েছিলো তার ডানার নিচে।যখন পাখিদের চোখ ফুটেছে, উড়ে গেছে। শঠতা আর বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষত নিয়ে এই মানুষটি পড়ে রয়েছেন একা। রাজ্য থেকে নির্বাসনে গহীন অরণ্যে। দিশেহারা মানুষটির এখন সম্বল নিজের সন্তান। আশায় বেঁচে থাকা। উপদেশ- ‘তোরা মানুষের মতো মানুষ হঅ।’সন্তানরা চেষ্টা করছে, এখনো পেরে ওঠেনি। দশজনের এক রাজ্যে তিনি এখন রাজা। সেনাপতি, সৈনিক নিয়ে চলছে রাজ্য। একের পর এক রাজ্য জয় করে চলেছেন। হয়তো আরও রাজ্য জয়ের স্বপ্নে বিভোর তিনি। একদিন বিশ্ব জয় করবে তার সেনাবাহিনী। শত আঘাতের ক্ষত নিয়েও আগলে আছেন তার পরবর্তী রাজ্য।রাজা আপনি দীর্ঘজীবী হোন। শান্তি আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক আপনার রাজ্য। জয়তু মহারাজ!লেখক: সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।এসইউ/পিআর

Advertisement