খেলাধুলা

প্রিমিয়ার ক্রিকেটে কালো দাগ

হোক তা ফুটবল ক্রিকেট কিংবা হকি- ঢাকার ক্লাব ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে ‘বিতর্ক’- শব্দটি জড়িয়েছিল, আছে, হয়ত থাকবেও। কোন বিতর্কিত ঘটনা ঘটেনি, এমন একটি ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা হকি লিগ কি হয়েছে কখনো? ঢাকার ক্লাব ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে যাদের নিবিঢ় সম্পর্ক, স্বাধীনতার পর থেকে যারা নিয়মিত ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি লিগ দেখেন, খোঁজখবর রাখেন- তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন না হয়নি। এ বিতর্ক বহুমুখী। কখনো লিগ শুরুর দিনক্ষণ নিয়েই হয়েছে রাজ্যের বিতর্ক। দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন বা বোর্ড একটি সময়সূচি বেঁধে দিয়েছে; কিন্তু ক্লাবগুলো তা মানেনি। বারবার দলবদলের তারিখ বদলেছে। ক্রিকেটে কয়েক বছর আগে পাঁচ-পাঁচবার তারিখ পাল্টে তবে দলবদল হয়েছে। আর লিগ শুরুর তারিখ পাল্টানোতো ঢাকাই রীতি। বিতর্কের এখানেই শেষ নেই। কোন সময় দল বদলকে কেন্দ্র করে বিতর্ক হয়েছে। খেলোয়াড় ছিনতাই, বিমান বন্দর ও ফেরিঘাট থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার ঘটনা, ফুটবলারদের গ্রেফতার ও জেলে পাঠানোর মত চরম বিতর্কিত ঘটনাও আছে অনেক। ’৭০ ও ’৮০ দশকে ঢাকার ফুটবলে প্রাণঘাতি সংঘর্ষও হয়েছে। খেলা দেখতে এসে অকাতরে প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটেছে। তবে এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ যেন অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেল। সর্বাধিক আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত ঘটনার পরিসংখ্যান ঘাঁটাঘাঁটি করলে হয়ত এবারের ক্রিকেট লিগ হবে এক নম্বর। এত বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা ও হৈ চৈ হয়নি কখনো। বিতর্ক ডালপালা ছড়িয়েছে মূলতঃ আম্পায়ার বরাদ্ধ ও আম্পায়ারদের খেলা পরিচালনা নিয়ে। একটি দলের ম্যাচে ঘুরে-ফিরে হাতে গোনা কজন আম্পায়ারের খেলা পরিচালনা, তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগ উঠেছে বিস্তার। প্রতিপক্ষের প্রতিবাদ-ক্ষোভ প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বোর্ডে যে শিবিরের পরিচালক সবচেয়ে বেশি, সেই আবাহনীকে বারবার বিকেএসপি মাঠে খেলতে দেয়া নিয়েও নানা মুখরোচক কথা চালু হয়ে গেছে। বিকেএসপিতে দর্শক কম হয়। বাইরের সাধারণ দর্শকের প্রবেশাধিকার সব সময়ই সীমিত। মিডিয়া উপস্থিতি, বিশেষ করে ঢাকা থেকে ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া ও ফটো জার্নালিস্টও থাকে সংখ্যায় কম- তাতে আম্পায়ারদের পক্ষপাতিত্বও কম গন্ধ ছড়াবে। এ চিন্তায় না কি বিকেএসপিতে আবাহনীর খেলা দেয়া হয়। এটা নিছকই অভিযোগ বলে মেনে নেয়া যেত,  যদি না আবাহনী ১১ ম্যাচের মধ্যে একটি বা দুটি কিংবা সর্বোচ্চ তিনটি ম্যাচ খেলতো বিকেএসপিতে। তাতো নয়। লিগ আর সুপার লিগ মিলে আবাহনী শেষ টানা ৫ ম্যাচই খেলেছে বিকেএসপিতে। আবার উল্টো মতও আছে। আরেক পক্ষর কথা, ‘আবাহনীর কর্তারা এটা জোর খাটিয়ে করেননি। সিসিডিএমের কর্তারা বোর্ড প্রধানসহ আরও চার প্রভাবশালি পরিচালকের দলকে যেচে সুবিধা দিতে চেয়েছে। পাছে তাদের অবস্থান সমৃদ্ধ হয়! তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আসরে একটু ভাল ভাল স্ট্যান্ডিং কমিটিতে জায়গা পান। আবার আম্পায়াররা বড় ম্যাচ করার সুযোগ পেতেই নাকি আকাশী-হলুদ শিবিরকে সন্তুষ্ট করার জন্য অতি উৎসাহি হয়ে ‘হাউ ওয়াজ দ্যাট’ শুনে কাল বিলম্ব না করে আঙ্গুল তুলে দিয়েছেন। আবার আবাহনীর ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে লেগ বিফোর উইকেটের জোরালো দাবিও হয়েছে উপেক্ষিত। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গেছে, সেই দল গুলো কি আর তা মানবে? মানেনি। তাদের অভিযোগের তীর সরাসরি আবাহনীর বিরুদ্ধে। তাদের দাবি আবাহনীর কর্তারা নিজেদের প্রভাবকে খাটিয়ে আম্পায়ার নিয়োগ দিয়েছেন। যারা আকাশী হলুদ শিবিরকে পক্ষপাত করছেন।  শুধু আবাহনীর কথা বলা কেন? আরও কটি দলকে সুবিধা দেয়া হয়েছে। কোন দলকে ফেবার করে হঠাৎ ভেন্যু পাল্টে ফেলা হয়েছে। একই মাঠে পাশাপাশি দুই পিচের একটি বৃষ্টিতে অক্ষুণ্ন, অন্যটি ভিজে একাকার হবার অভিনব ঘটনাও ঘটেছে। সেটাও বিকেএসপিতে। রেলিগেশনের খাঁড়ায় ঝোলার অপেক্ষায় থাকা ব্রাদার্স আর পয়েন্ট টেবিলে ওপরের দিকে থাকা রূপগঞ্জের ম্যাচটি না হলে ব্রাদার্সের আর রেলিগেশন লিগ খেলতে হয় না। অভিযোগ আছে ওই অবস্থায় কিউরেটর ও মাঠ কর্মীরা ইচ্ছে করেই বৃষ্টির হাত থেকে মাঠ ও উইকেট ঢাকেননি। তাতে ম্যাচটি পন্ড হয়ে যায়। ১ পয়েন্ট পাওয়ার সুবাদে কলাবাগান একাডেমি আর সিসিএসের সঙ্গে আর ব্রাদার্সকে রেলিগেশন লিগ খেলতে হয়নি। আরও বিতর্ক আছে। এই তো গত ১২ জুন, সুপার লিগের প্রথম ম্যাচে বিকেএসপিতে আবাহনী-প্রাইম দোলেশ্বর ম্যাচ একটা পর্যায় গিয়ে অভিনব কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। রিজার্ভ ডে‘তেও তা গড়ায়নি। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান রকিবুলের বিরুদ্ধে স্ট্যাম্পিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন আবাহনী অধিনায়ক তামিম ইকবাল। তার দাবি আম্পায়াররা নিশ্চিত আউট দেননি। প্রতিবাদ ও ক্ষোভে ফেটে আম্পায়ারের সঙ্গে বচসায়ও লিপ্ত হন তিনি। টিভি প্রতিবেদন ও পত্রিকায় ছাপা হওয়া ছবিতে পরিষ্কার, উত্তেজিত তামিম অখেলোয়াড়োচিত মনোভাব দেখিয়েছেন। পরে মিডিয়ায় দুঃখ প্রকাশও করেছেন; কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, আম্পায়ারের রিপোর্টে তার ছিটেফোটাও ছিল না। অভিযোগ আছে, বিকেএসপির শিক্ষক এবং ওই ম্যাচের ম্যাচ রেফারি মন্টু দত্ত নাকি তামিমের বিরুদ্ধে রিপোর্টে কিছুই বলেননি। তা নিয়েও বড় ধরনের বিতর্ক আছে। ভিডিও ক্লিপস পরিষ্কার বোঝা গেছে, তামিম শৃঙ্খলা ভঙ্গের কাজ করেছেন। যার শাস্তি অন্তত এক ম্যাচ সাসপেন্ড, না হয় বড় অংকের জরিমানা; কিন্তু তার কিছুই হয়নি। এসব কারণেই বিতর্ক ডাল পালা গজিয়েছে। বোর্ড প্রধান কিছু বিষয় খুঁটিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দিলেও মাঠ বরাদ্ধ নিয়ে আগের সেই ছেলেখেলা অব্যাহত। তার প্রমাণ, দুই জনপ্রিয় দল আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ প্রথমবারের মত বিকেএসপিতে অনুষ্ঠিত হওয়া। বিকেএসপি মাঠে লিগ শুরুর পর থেকে এর আগে যা কোনদিন হয়নি। এবার তা হলো। আবাহনীর চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান একটা লিখিত প্রতিবাদ দিলেও তারপর টু শব্দটি করেনি। ক্রিকেট পাড়ায় জোর গুঞ্জন, এক সময়ের প্রবল প্রতিপক্ষ আবাহনী-মোহামেডান এখন হরিহর আত্মা! কে কার বিরদ্ধে অভিযোগ করবে? সব মিলে এবারের লিগের গায়ে কাল দাগ। সেই দাগে ঢাকা পড়ে গেছে, ফিকে হয়েছে মাঠের ক্রিকেট। তবুও এত বিতর্কের পরও চমৎকার ক্রিকেট হচ্ছে। জাতীয় দল, ‘এ’ দল ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোন কার্যক্রম না থাকায় সবাই শতভাগ মনোযোগ ও মনোসংযোগি থাকার কারণেই ব্যক্তিগত নৈপুন্যের দ্যুতি ছড়িয়েছে প্রচুর। তাই মাঠের ক্রিকেট ছিল আকর্ষণে ঠাসা। সোনালী দিনগুলো পিছনে ফেলে আসা মাশরাফি এ লিগেই করেছেন দুর্দান্ত সেঞ্চুরি। যেটা আবার দ্রুততম রেকর্ডও বটে। প্রচণ্ড গতিতে বল করতে না পারলেও বুদ্ধি খাটিয়ে লাইন ও লেন্থে বল ফেলে ৬ উইকেটের পতন ঘটিয়ে জানান দিয়েছেন ভাল করায় বয়স বাঁধা নয়। দৃঢ় সংকল্প ও ইচ্ছেটাই আসল। মধ্য তিরিশে পা রেখেও মোহাম্মদ শরিফ হ্যাট্ট্রিক করে এসেছেন পাদ প্রদীপের আলোয়। শাহরিয়ার নাফীস, তুষার ইমরান, অলক কাপালির মত সাবেকের তকমাধারীরাও কম যাননি। তরুণ আল আমিন, মোসাদ্দেক সৈকত আর নাইম জুনিয়ররা বহু ম্যাচে জ্বলে উঠে ব্যবধান গড়ে দিয়েছেন। ঘরের ক্রিকেটে নিজেকে মেলে ধরতে না পারার দায়মুক্ত সাকিব আল হাসানও এবারের লিগে এক ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি (৫৭) ও ৫ উইকেট শিকারি হয়ে ঢাকা লিগে নিজের সেরা পারফরমেন্স দেখিয়েছেন। লিগের প্রথম পর্বে লড়াই হয়েছে সেয়ানে সেয়ানে। শেষ রাউন্ড পর্যন্ত ১০ দল ছিল প্রায় কাছাকাছি। ১১ নম্বর রাউন্ডেই নির্ধারিত হয়েছে সুপার লিগ খেলবে কোন ছয় দল? এটাও নজিরবিহীন। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে প্রায় তিন যুগ যাদের সম্পৃক্ততা, সেই গাজী আশরাফ হোসেন লিপু ও সারোয়ার ইমরানসহ অনেকেই বলেছেন, এত জোর লড়াই হয়নি কখনো। একদম শেষ রাউন্ডে গিয়ে সুপার লিগের ছয় দল নির্ধারিত হবার ঘটনা এটাই প্রথম। অথচ এমন এক লিগের গায়েই কি না লেগেছে কালো আঁচড়। জাগো চ্যাম্পিয়নের চতুর্থ সংখ্যা পুরোটা পড়তে ক্লিক করুণ এই লিংকে...আইএইচএস/পিআর

Advertisement