মতামত

আমাদের কোনো ‘হিরো’ হয় না!

সব পেশারই মর্যাদা আছে। আবার সব পেশাতেই- বিশেষত: আমাদের মতো দেশে দুর্নীতিও আছে। কিন্তু কিছু পেশা আছে অনন্য সাধারণ। সেসব পেশার মানুষদের দুর্নীতিগ্রস্ত হতে দেখলে সাধারণ মানুষ বিস্মিত হয়, রাগ হয় তার চেয়েও বড় কথা কষ্ট পায়। ধরুন সাংবাদিকতা। রানাপ্লাজা ধসের ঘটনার সময় আমার মনে আছে, কত অসহায় মানুষ যে এসে হাত চেপে ধরতো। একবার একজন মা আমাকে জাপ্টে ধরেছিল শক্ত করে, ‘আপা আমার মেয়েটারে বাইর করে দ্যান, আমার মাটা ছোট, ওর বাপ ফেলায়া গেছে, এতিম আমার বাচ্চাটা, আপা বাইর করে দ্যান।’  হাতে ১৫/১৬ বছরের একটা মেয়ের ছবি স্টুডিওতে তোলা। আমি কি বলবো বুঝে পাই না, আমারও কান্না পায়। অ্যাজ ইফ হাতে বুম আছে বলেই দিনরাত এক করে কাজ করা সেনাবাহিনীর মতোই আমি বা আমার ক্যামেরাপার্সন মহা ক্ষমতাধর কোনো কিছু। আমি মাত্র পাঁচ কি ছয়দিন রানাপ্লাজায় গিয়েছি। আমার আরও সহকর্মীরা যারা টানা কাজ করেছে, আরও হৃদয়স্পর্শী সব ঘটনা বের করে এনেছে, তাদের কাছে না বলা এমন আরো কত কথা আর ঘটনা আছে। তো এই সাংবাদিকদের দুর্নীতির কোনো খবর যদি পাওয়া যায়, মানুষ কষ্ট পায়। আস্থা হারায়। ঠিক সেরকমই আরেকটা পেশা চিকিৎসক। সেই ছোট বেলায় মনে আছে আপনাদের, এইম ইন লাইফ-এ কি লিখতাম আমরা। ইংরেজি এসএর বইগুলোতে মহান চিকিৎসা পেশা ছিল এক নম্বরে। মানুষের সেবা করাই আমাদের একমাত্র মোটো ইত্যাদি ইত্যাদি। তো সেই পেশাটা নিয়ে আবার ছোটবেলা থেকেই নেতিবাচক কথাবার্তাও কম শুনিনি। শাহাদুজ্জামানের কয়েকটি ভাঙা বিধ্বস্ত হাড় পড়েছিলাম। এই বইটার ভেতর দিয়ে এই পেশাটাকে একটা চিত্রকর্মের মতো নানান দিক দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছিলাম। কিন্তু এবার খুব বিস্মিত বোধ করছি। সোহাগী জাহান তনুর ঘটনায়। দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তে ডা. কামদা প্রসাদ সাহা জানিয়েছে, তনুর সাথে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি, "যৌন সংসর্গ" ঘটেছে। এই "যৌন সংসর্গ" তনুর ইচ্ছায় না কি জোরপূর্বক তা বলেননি তিনি। এই পেশার তো একটা ন্যূনতম নৈতিকতা আছে তাই না? ঘটনাটা প্রথম থেকে শুধুই নারীর প্রতি সহিংসতায় আর আটকে নেই, বরং সেসব ছাড়িয়ে অনেকবেশি রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঐ যে এইটুকু তো সাধারণ মানুষ আশা করতেই পারে যে, এইরকম একটা ঘটনায় অন্তত ডাক্তার কোনো মিথ্যা রিপোর্ট দেবে না? এমন না যে এর আগে কোনো ডাক্তার প্রভাবিত হয়ে ধর্ষণের রিপোর্টে মিথ্যা কথা লেখে নাই, হয়তো লিখেছে। কিন্তু যেহেতু তনুর ঘটনাটা রাজনৈতিক সেজন্যই বোধহয় কামদা প্রসাদ সাহার উচিত ছিল এই পেশাটার মান উন্নত রাখার একটা চেষ্টা করা। হয়তো বিষয়টা এতো সহজ না। এর সাথে আরও কত ধরনের রাজনীতি সম্পৃক্ত। আরও কতধরনের ভীতি আর ঘাড়ের কাছে জলপাই রঙের অন্ধকারের প্রাণীদের নিঃশ্বাস। কিন্তু তবু আমার ইচ্ছে করে, এই ভয়াবহ নীতি-নৈতিকতাহীন সময়টায় একজন কেউ "হিরো" বের হোক। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সাঁতারু ব্রুক টানার যে মেয়েটাকে রেপ করেছিল, সেই মেয়েটির বিবৃতিতে দারুণ একটা কথা ছিল। মেয়েটিকে উদ্ধার করা দুই নৈশ প্রহরী সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, "এই ঘটনায় আসল নায়ক ওরাই" । আফসোস যে আমাদের দেশে প্রশাসন আর সংশ্লিষ্টরা কখনও "হিরো" হওয়ার সাহস আর ইচ্ছাটা করেন না। ইয়াসমিন রাতে রওনা দিয়ে সাধারণ কোনো মানুষের কাছে ধর্ষিতা হয়নি, ভোররাতে তাকে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিয়ে বাসের হেল্পার বলেছিল, মেয়েটাকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে, ইয়াসমিন সেই নিরাপত্তা বিধানকারীদের দ্বারাই ধর্ষিতা হয়ে মরেছিল। যাই হোক, আমার খুব ইচ্ছা করে, এই দেশে এরকম চিকিৎসক দেখি, যারা ড্যাব বা স্বাচিবের বাইরে এসে নিজেদের নৈতিকতার জায়গাটা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রাখবেন। রাজনীতি সচেতন হওয়া আর রাজনীতি করা দুটো আলাদা। এই দুই ভিন্নতাকে তারা ভিন্ন করে দেখতে শিখুন।লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার,ডিবিসি নিউজএইচআর/এবিএস

Advertisement