জাতীয় দলের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে যার ভুরি ভুরি কীর্তি। রেকর্ডের পর রেকর্ড সঙ্গী, তা হোক না মোহামেডানের বিরুদ্ধে; কিন্তু একই ম্যাচে ২২ বলে ৫৭ আর ১৮ রানে ৫ উইকেট শিকার- সাকিব আল হাসানের মানে এ আর এমনকি? তাইনা। অতিবড় সাকিব ভক্তও হয়ত তাই বলবেন; কিন্তু জেনে অবাক হবেন, শুনেও হয়ত বিশ্বাস করতে চাইবেন না। এটাই সত্যি। বুধবার বিকেএসপিতে আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথে আবাহনীর আকাশী-হলুদ জার্সি গায়ে সাকিব যে অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে এটাই তার সেরা। যত কম বলেই হোক না কেন, একই ম্যাচে পঞ্চাশ হাঁকানোর পাশাপাশি ৫ উইকেট! আগে কখনই ছিল না তার। কি করে থাকবে? ঢাকা লিগে যে এর আগে কখনো ৫ উইকেটই পাননি তিনি। বুধবার বিকেএসপিতে আবাহনীর সোনালী সাফল্য খচিত দিনে সাকিবও প্রথম ৫ উইকেট শিকারী! পরিসংখ্যান সে সত্যই জানান দিচ্ছে। তার মানে ঢাকা লিগে এখন পর্যন্ত এটাই সাকিবের সেরা অলরাউন্ড নৈপুণ্য। সাকিব নিজেও সে কথা জানালেন। বুধবার পড়ন্ত বিকেলে জাগো নিউজের সঙ্গে মুঠোফোন আলাপে সাকিবের নিজের মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে এই সত্য। ‘হ্যাঁ পরিসংখ্যান ধরলে ঢাকার ক্লাব লিগে এটাই আমার এক ম্যাচে সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। বিশ্বাস করুন, আমার মনে হয় না, এর আগে কখনোই ৫ উইকেট পেয়েছি। যেহেতু ৫ উইকেট ছিল না, তাই হাফ সেঞ্চুরির পাশে ৫ উইকেট শিকারের ঘটনাও প্রথম’- বললেন সাকিব।কেমন লাগছে এমন নজরকাড়া পারফরম্যান্স করে? ‘হ্যাঁ ভালো অবশ্যই। তবে আমি নিজেকে সেভাবে কৃতিত্ব দিতে চাই না। আমার মনে হয় লিটন দাস ও দিনেশ কার্তিকের জোড়া সেঞ্চুরিতেই আসলে আমাদের সাফল্যের প্লাটফর্ম রচিত হয়ে যায়।’যার গায়ে বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডারের তকমা ছিল দীর্ঘদিন। তার নিজ দেশে ৫০ ওভারের লিগে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স প্রথম! মেলানো সত্যিই কঠিন। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। আরও আছে।টেস্ট যিনি এক ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট (২০১৪ সালের নভেম্বরে খুলনায়), জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ১৩৭ ও ১২৪ রানে ১০ উইকেট শিকারের অনন্য রেকর্ডের অধিকারী, এছাড়া এক ইনিংসে ১৪৪ রানের পাশাপাশি যার আছে ৬ উইকেট (২০১১ সালে শেরেবাংলায় পাকিস্তানের সঙ্গে) সেই সাকিবের কিন্তু এখন পর্যন্ত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে সেঞ্চুরি নেই! তার সত্যিই ঢাকা লিগে সেঞ্চুরি আছে কি না? সাকিবের বেশ রসিকতা মেশানো জবাব, ‘ঢাকা লিগে আমার সেঞ্চুরি নেই, আমি শতভাগ নিশ্চিত। আর ৫ উইকেটও ছিল না, এটাও ৯০ ভাগ কনফার্ম।’সত্যিই তাই! ইতিহাস তেমনই সাক্ষী দিচ্ছে। অবশ্য একটা কথা না বললেই নয়। ব্যাট ও বল হাতে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলা সাকিবের এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতেও এক ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট নেই। ১৫৭টি একদিনের ম্যাচে ২০৬ উইকেট পাওয়া এ বাঁহাতি স্পিনার এক ম্যাচে ৫ উইকেট পেয়েছেন মোটে একবার। সমালোচকদের ভাষায়, ‘সাকিব ঢাকা লিগে কখনই তেমন উজ্জ্বল নন। তার ব্যাট ও বল সেভাবে আলো ছড়ায় না।’ এক বছর যৌথভাবে সর্বাধিক উইকেট শিকারি হলেও অলরাউন্ডার সাকিব কোন বছরই সে অর্থে নজরকাড়া পারফরমার নন। কোনোবার সেরা অলরাউন্ডারও হতে পারেননি। দল বদলে সবার চেয়ে তার মূল্য বেশি উঠলেও মাঠে কোনোবারই সাকিব তার যথার্থতার প্রমাণ দিতে পারেননি। এক কথায় সাকিব এখন পর্যন্ত কোনোবারই লিগ নির্ধারণী ভূমিকা রাখতে পারেননি। এগুলো শুধু সমালোচকদের কথা নয়। পরিসংখ্যানও তা জানান দিচ্ছে। সত্যিই দেশ সেরা ক্রিকেটার ঢাকা লিগে তেমন স্বপ্রতিভ নন। সাকিব নিজেও তা জানেন এবং মানেনও। তাই তো এ সত্য স্বীকারে এতটুকু দ্বিধা নেই তার, ‘সত্যিই ঢাকা লিগে আমি কখনোই অমন ভালো খেলিনি।’ কেন এমন হয়? কী কারণে ঢাকা লিগে সাকিব ‘সাকিবে’র মত উজ্জ্বল নন? তবে কি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা আইপিএল, বিগব্যাশ, সিপিএল, বিপিএলের মত ঢাকা লিগ সেভাবে টানে না তাকে? ভালো করায় উৎসাহ পান না কিংবা তেমন কিছু? সাকিবের হাসিমাখা জবাব, ‘না না, তেমন কিছু নয়। আমি চেষ্টা করি সব সময়ই ভালো করতে। এখন যে কোন কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত হয়ত সে চেষ্টা খুব সফল হয় না।’ কোনো অজুহাত কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চান না, তবে সাকিবের অনুভব, তার ঢাকা লিগে ভালো না খেলার একটা কারণ আছে। ‘আগেই বলে রাখি এটা কোনো অজুহাত নয়। তবে ঢাকা লিগে ক্লাবের সাথে প্রস্তুতির সময়টা খুব কম পেয়েছি। বেশিরভাগ সময়ই দেখা গেছে লিগ হয় কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট বা সিরিজের আগে কিংবা পরে। কোন সিরিজের আগে কিংবা জাতীয় দলের বিদেশ সফর- সিরিজ শেষে তড়িঘড়ি করে ফিরে কয়েকটি ম্যাচ খেলা হয়। এতে করে সত্যিকার প্রস্তুতিতে ঘাটতি থেকে যায়। দলের সঙ্গে সমঝোতা হয় কম। নিজেকে মানিয়ে নেয়ার অবকাশও মেলে কম।’ কথাটি মুখ ফুটে বলেননি; কিন্তু অভিব্যক্তিতে বোঝা গেছে, সেই অব্যক্ত সংলাপটি হলো, বেশিরভাগ সময় জাতীয় দলের কিংবা তার ব্যক্তিগত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আগে-পরে লিগ হওয়ায় সত্যিকার মনোযোগ-মনোসংযোগটাও তেমন হয় না। তাই হয়ত পারফরমেন্সটা কাঙ্খিত মানে পৌছায় না।’ তার ক্যারিয়ারের শুরুতে যেমন ছিল, এখন অনেকটাই নেই। মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে যে উত্তাপ, গরম আবহাওয়া, সাজ সাজ রব। মাঠ ও বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ- এসব এখন অনেক কম। তারপরও সাকিবের ধারনা, এ ম্যাচটা মিরপুরের শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে হলে আরও বেশি দর্শক দেখতে পেতো।’ দর্শক কম হলেও বিকেএসপিতে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে প্রথমবার ৫ উইকেট শিকার এবং ম্যাচে হাফ সেঞ্চুুরির পাশাপাশি ৫ উইকেট দখলের অধরা কৃতিত্ব- সাকিবকে একটু হলেও পুলক জাগাচ্ছে। কারণ একটাই- বিকেএসপি যে তার ‘সেকেন্ড হোম!’ তার ক্রিকেটে হাতেখড়ি, ক্রিকেট শেখা এবং ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুতিকাগার যে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান! সেই মাঠে এমন পারফরমেন্স অন্যরকম ভাল লাগা বৈকি। তাই তো মুখে এমন কথা, ‘হ্যাঁ তাতো অবশ্যই। বিকেএসপিতো আমার ঘরের মতই। সেখানে ক্যারিয়ারের এক সোনালী সাফল্যর দেখা মেলা একটু হলেও বাড়তি আনন্দের। রোমাঞ্চের।’এআরবি/আইএইচএস/এমএস
Advertisement