অপমৃত্যু বা খুন হওয়া মানুষের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার বা বিচার চাইবার ক্ষমতা নেই। উত্তরাধিকারীরাই তাঁর পক্ষে বিচারের লড়াইয়ে নামেন। অপঘাতে মৃত্যু বা খুন হওয়া মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়া সব সময়ই কঠিন। কারণ জীবিত অবস্থাতেই তাঁরা অন্যদের তুলনায় দুর্বল ছিলেন। আর মৃত্যুর পরেতো একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন। মৃতদেহের সাথে খুন হওয়ার সঠিক কারণটি ভস্ম করে অথবা কবরে নিয়ে চলে গেছেন । হত্যা অথবা ধর্ষণের সঠিক কারণ নির্ণয়ে এবং অপরাধী শনাক্তকরণে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মৃত ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবলম্বন। কিন্তু অশুভ শক্তি বা লোভের বশবর্তী হয়ে সত্য উদ্ঘাটনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি যদি তা ঢেকে ফেলেন, তাহলে তিনি একজন মৃত ব্যক্তি বৈ অন্য কিছু নন। নিজের চামড়া বাঁচানো এবং হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যারা একজন মৃত মানুষের প্রতি অন্যায় করতে কুণ্ঠিত হন না তাদের মানুষ ভাবতে বড় দুঃখ হয়। প্রসঙ্গটি সোহাগী জাহান তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সংক্রান্ত। তনু হত্যাকাণ্ডের পর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ময়নাতদন্ত বিষয়ক জটিলতা ও ধূম্রজাল সমগ্র জাতিকে বিস্মিত আর হতবাক করে দিয়েছে। যদিও সত্য গোপন করার অপচেষ্টা আদতে ঢেকে রাখা সম্ভব হবে না, কেননা সিআইডির ডিএনএ প্রতিবেদনে ইতোমধ্যে তনুর অন্তর্বাসে তিন ব্যক্তির বীর্যের প্রমাণ মিলেছে। একটি প্রশ্ন আমাদের সবসময় তাড়িত করছে যে ডাক্তার কামদা প্রসাদ সাহা কেন ডিএনএ প্রতিবেদনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন? কেন তিনি ডিএনএ প্রতিবেদন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেবেন না বলে গোঁ ধরলেন? অবশেষে রোববার দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে প্রথমবারের মতো এবারও অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করা হয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। কামদা প্রসাদ সাহা যে প্রতিবেদনটি প্রদান করেছেন, তাতে প্রথম ময়নাতদন্তের ফলাফলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন। কিন্তু সেটি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তার সুর ও প্রকাশ ভঙ্গি ছিল অত্যন্ত কৌশলপূর্ণ। তাঁর বক্তব্যে তাঁকে খুব বিরক্ত, ব্যস্ত এবং গণমাধ্যমের প্রতি অসহিষ্ণু বলে মনে হয়েছে। তনু হত্যার প্রথম ময়নাতদন্তটি সম্পন্ন করেন তাঁরই জুনিয়র সহকর্মী চিকিৎসক ডা. শারমিন সুলতানা। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন- তনুকে ধর্ষণ ও হত্যার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। শুরু থেকেই ধর্ষণের সন্দেহ করা হলেও এ প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত। যার দরুন এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রথম ময়নাতদন্তে তনুর মাথার পেছনে জখমের কথা গোপন করা হয়েছে। তাঁর কানের নিচে আঁচড়ের আঘাতকে পোকার কামড় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সমগ্র দেশের মানুষ যখন অধীর আগ্রহে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, তখন এতো গুরু দায়িত্বে নিয়োজিত একজন চিকিৎসক সেবা, পেশাদারিত্ব বা মানবিক বোধের পরিচয় প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। কারণ গণমাধ্যমে কথা বলার সময় তাঁর মৌখিক অভিব্যক্তিতে মৃত তনুর প্রতি কোনো সম্মানবোধ প্রকাশ পায়নি। অত্যন্ত অবহেলার সাথে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তিনি বলেন, তনুর মরদেহে পচন ধরায় ময়নাতদন্তে হত্যার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে `সেকচুয়াল ইন্টারকোর্সের` আলামত পাওয়া গেছে। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আপনারা বুঝে নেন’ । মৃত্যুর আগে তনু ‘ধর্ষণের’ শিকার হয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি তা কৌশলে এড়িয়ে যান। তাঁর এ বক্তব্যে শুধু তনুর পরিবারই ক্ষুব্ধ হয়নি, ক্ষুব্ধ হয়েছে সমগ্র দেশবাসীও। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণ নিয়ে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষা `সেকচুয়াল ইন্টারকোর্স` বা যৌন সংসর্গ বলে উল্লেখ করলেও অন্য ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষা হচ্ছে `জোরপূর্বক যৌন সংসর্গ` । শুধু তাই নয়, তার তদন্ত দলের একজন চিকিৎসক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষা বাদ দিয়ে অনেকটা দার্শনিকের মত মন্তব্য করেছেন যে, ‘আপনার স্ত্রীর সাথে যৌন সংসর্গটিও ধর্ষণ হতে পারে’। এতো জটিলতার আশ্রয় নিয়ে এই দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন একদিন তা নিশ্চয়ই প্রকাশ হবে। যে পুলিশ বিভাগের প্রতি কামদা প্রসাদ অসহযোগিতামূলক আচরণ ও চ্যালেঞ্জিং মনোভাব প্রকাশ করছিলেন, তাঁদেরই তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষার পরিবর্তে আইনের ভাষায় উপদেশ দিলেন ‘সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স’র উপর জোর দিয়ে মামলা তদন্ত করতে। তাঁকে কি এই প্রশ্ন করা সঙ্গত নয় যে, ‘সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেনন্স’ কি চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষা নাকি আইনের পরিভাষা? যদিও ময়নাতদন্তের মাধ্যমেই মৃত্যুর কারণ ও প্রকৃতি উদ্ঘাটন করা হয়ে থাকে এবং তা নির্ণয়ের সফলতার হারও শতকরার প্রায় কাছাকাছি, কিন্তু দুইবার তদন্ত করেও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ তা নির্ণয়ে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। কামদা প্রসাদ যদি মনে করেন মৃতদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য উপযোগী ছি না, তাহলে তিনি তা আগেই মহামান্য আদালতকে জানাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি ডিএনএ প্রতিবেদনটি পাওয়ার জন্যই উদগ্রীব ছিলেন, সম্ভবত এই কারণে যে, তিনি প্রতিবেদনটি অনুকরণ করতে বা এই প্রতিবেদনের সাথে সংঘাতপূর্ণ হয় এমন বিষয় পরিহার করতে চেয়েছিলেন। হয়তোবা এ কারণেই এতো দীর্ঘ কালক্ষেপণের পর একটি নাটকীয়তার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। প্রশ্ন জাগে তিনি কি তাহলে তার চিকিৎসক সহকর্মী শারমিন সুলতানা বা অন্য কাউকে রক্ষা করতে চাইছেন? বিষয়টি বাংলাদেশের সকল সচেতন ও নিষ্ঠাবান মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলছে । লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড sharminakhand007@yahoo.comএইচআর/এবিএস
Advertisement