সোহাগী তনু আজ মৃত। দেশের স্বনামধন্য ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ময়নাতদন্ত করে অদ্যাবধি সেটিই নিশ্চিত করেছেন। প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে কিছুই পাওয়া যায়নি। ধরে নিতে হবে, ঘটনার রাতে সুস্থসবল তনু ক্যান্টনমেন্টের নির্জন স্থানে অবিশ্বাস্যভাবে আজরাইল (আঃ) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থী হয়েছিল। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত শেষে প্রায় আড়াই মাস কালক্ষেপণের নাটক মঞ্চায়নের পর ময়নাতদন্তকারী ডা. কামদা প্রসাদ আমাদের প্রসাদ দিলেন এক অশ্বডিম্ব! তনুর মা সেই প্রসাদ দেখেই বমি শুরু করেছেন, অনেকের বদ হজম হয়েছে, অনেকে হজম করার চেষ্টা করছেন। আর আমার সেই প্রসাদে প্রসব বেদনাসম ব্যথা শুরু হয়েছে। হায়রে ফরেনসিক বিজ্ঞান! ওরা যে তোকেই ধর্ষণ করে দিচ্ছে!! আমি নিজে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। দেশ বিদেশের অভিজ্ঞতা, পদবি আর শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে বিশেষজ্ঞের তকমাটা ফেলে দেবে এমন দুঃসাহসী কাউকে দেশ বিদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাকে আমার পরিচিত অনেকেই তনুর ব্যাপারে কলম না ধরতে অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর নয়। কিন্তু প্রসব বেদনাসম বেদনা কি প্রসব ছাড়া দূর হবে? তাই আবার কলম ধরতেই হল। অত্যন্ত বিরক্ত চিত্তে আমি কলম ধরেছি। দ্রুত অগ্রসরমান ফরেনসিক বিজ্ঞানের একি হাল! এ যুগে মন যা চায় তাই কি লিখে দেয়া যায়। তনুর ময়নাতদন্তের কোনো প্রতিবেদন আমি দেখিনি। তবে না দেখে অর্থাৎ চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় প্রথম ময়নাতদন্তে সঠিক কার্যবিধি অনুসরণ করা হয়নি। ময়নাতদন্তকারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যত জ্ঞানীই হন না কেন, দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তার ভাবনার পরিধি আরো প্রসারিত হওয়া উচিৎ ছিল। অন্যথায় এ পেশার উপযুক্ত তিনি নন। প্রথম ময়নাতদন্তের মুখপাত্র ডা. কামদা প্রসাদকে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত দলের দলনেতা নির্বাচন গোদের উপর বিষফোড়াসম অস্বস্তিকর। যিনি প্রথম ময়নাতদন্তকারীকে রক্ষা করে বক্তব্য দেন, তাকে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তকারী দলের দলনেতা নির্বাচন যেন শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়া। তিনি নিজেই বা এই দায়িত্ব গ্রহণে সায় দেন কীভাবে? তার কি যুক্তিযুক্ত কারণে বিব্রত হওয়া সমীচীন ছিল না? অদৃশ্য কোনো শক্তি এখানে ক্রীড়নক নয় তো ! দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের পর তার প্রতিবেদন দিতে প্রায় আড়াই মাস লেগে গেল। কোনো রকম প্রাথমিক প্রতিবেদনও দেয়া হলো না। অবশেষে ডিএনএ রিপোর্টে একাধিক ব্যক্তির ডিএনএ/বীর্যের উপস্থিতিতে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে লেখা হলো, মৃত্যু-পূর্ব যৌন মিলনের আলামত প্রাপ্তির কথা। এই একটি লাইনে, একটি মৃত মেয়ের চরিত্রে এঁকে দেয়া হল চরিত্রহীনতার অপবাদ। এই ডিএনএ/বীর্য সেখানে কীভাবে এলো অথবা আসতে পারে তার কী কোনো তদন্ত হয়েছে? তিনজন মানুষের বীর্য/ডিএনএ যদি সত্যিই থেকে থাকে এবং তা যদি যৌনমিলনের ফলে হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মৃত তনু হয় বেশ্যা নতুবা ধর্ষিতা ছিল। যেহেতু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষিতা কথাটি উল্লেখ নেই (খবরের কাগজের মাধ্যমে জানা), তাই সেই প্রতিবেদন তনুকে বেশ্যাসম নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নবদিগন্ত উন্মোচিত করে দিল নয় কি? এটি মাথায় রেখে, তনুর চরিত্রে অপবাদ লেপনের আশঙ্কাটি বিজ্ঞ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কি খোলাসা করা উচিত ছিল না? এখন ডিএনএ প্রতিবেদন যদি ভুল অথবা স্পরশাদি দ্বারা দূষিত হয়ে থাকে, তাহলে তনুকে অপবাদ দেয়ার দায় কে নেবে? কি অসুবিধা ছিল যদি প্রতিবেদনে শুধু ভেজাইনাল সোয়াব সংগ্রহের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয়া হতো? ডিএনএ প্রাপ্তি তো ডিএনএ পরীক্ষার ফসল। সেটিকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে জুড়ে দেয়া যায় কিন্তু তার উপর ভিত্তি করে কোনো মতামত দেয়া যায় না। তাছাড়া সেটি দেয়া কি খুব জরুরি ছিল? ডিএনএ পরীক্ষা যদি এতই জরুরি হয়ে থাকে, তাহলে প্রথম ময়নাতদন্তে কেন ডিএনএ পরীক্ষা করা হল না? দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের সময় মৃতদেহে পচন ছিল, তাই বিজ্ঞ ময়নাতদন্তকারীরা কিছু পাননি। গ্রীষ্মের ফুটন্ত আবহাওয়ায় ১০ দিনের পুরনো দেহে পচন থাকা অস্বাভাবিক নয় কিন্তু সেখান থেকে কিছু পাওয়া যাবে না এটা সাধারণ লোকজন বিশ্বাস করতে পারে; তবে দেশের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরাও বিশ্বাস করবেন না। এই ময়নাতদন্ত কি তারা নিজেরা করেছিলেন নাকি নাকে রুমাল দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ডোম দিয়েই সেরে ফেলেছেন? সম্ভাব্য জখম স্থানের চামড়া বা মাংসপেশীর কোনো হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা কি করা হয়েছিল? মুখে বললে হবে না, ছবি বা স্লাইডের প্রমাণ থাকতে হবে। একটি ভুল ঢাকতে অনেকগুলো ভুল করতে হয়। তবে বিদ্যা আর অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলে অনেক সময় নিজের ভুল বুঝতে পারাও দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। সেইসব ক্ষেত্রে এরকম অশ্বডিম্বের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রসবিত হয়। এরকম একটি অশ্বডিম্ব প্রসব একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের জাগতিক সম্মান ভূলুণ্ঠনের জন্য যথেষ্ট। লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া। ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ।এইচআর/পিআর
Advertisement