গত কয়েক বছরের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কিছুটা স্থিতিশীল হয়। ২০১৪ সালে স্থিতিশীলতার স্বপ্ন জাগিয়ে বছর শুরু হয় পুঁজিবাজারে। তবে বছর শেষে বিনিয়োগকারীদের সেই স্বপ্ন বাস্তবে তা পূরণ হয়নি। বছর শেষে লেনদেন কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। এই সময়ে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং স্টক এক্সচেঞ্জ বেশ কিছু সংস্থারমূলক পদক্ষেপ নিলেও তার সুফল পায়নি বিনিয়োগকারীরা। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি তার কিছু সুফল পাওয়া যাবে আগামী বছরে। এ বছরও প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদনে হিড়িক ছিল পুঁজিবাজারে। আর্থিক প্রতিবেদন সঠিক নিয়মে না দেখে অনুমোদন দেওয়ায় সমালোচনার মুখে পরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এমনকি অর্থমন্ত্রণালয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কে চিঠি দিয়ে আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়। বরাবরের মতো বিদায়ী বছরেও সক্রিয় ছিলো কারসাজি চক্র। বিশেষ করে দূর্বল মৌলভিত্তি ও ছোট মূলধনী কোম্পানির শেয়ারকে কেন্দ্র করে কারসাজি চক্র ছিলো সক্রিয়। অলোচিত এ সময়ে বিএসইসি ব্যস্ত ছিলো আইপিও এবং রাইট শেয়ার অনুমোদন দিতে। এ সুযোগে বাজার থেকে চলে গেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। ফলে লেনদেন সংকটে বাজারে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে অস্থিতিশীলতা। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে যাওয়ায় পুঁজিবাজারে প্রবাসি ও বিদেশিদের বিনিয়োগে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বছর শেষে বাজারে যোগ হয়েছে আড়াই লাখ বিনিয়োগকারী।জানা গেছে, ৫ জানুয়ারি নির্বানের পর নতুন সরকার গঠন ও ১৪ ফেব্রæয়ারি উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের প্রথম পরিচালনা পরিষদ গঠনে বিনিয়োগকারীদের মধ্য পুঁজিবাজার নিয়ে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর এবং বিএসইসি’র বিভিন্ন রকম প্রজ্ঞাপনকে ইস্যু, ফেসবুকে সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ ও মোবাইল ফোনে এসএমএসসের মাধ্যমে বাজারে গুজব ছড়িয়ে আইটেম ওয়াইজ (কোম্পানি ভিত্তিক) কারসাজি চালিয়েছে একটি চক্র। এর ফলে বছর শেষেও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করেছে দেশের পুঁজিবাজারে।এদিকে, আলোচিত এ বছরে মোট ২১ কোম্পানিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১ হাজার ৩২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা তুলে নেয়ার অনুমোদন দিয়েছে বিএসইসি। এছড়া রাইট শেয়ার ইস্যুর অনুমোদনের মাধ্যমে ৯টি কোম্পানি ২০৫ কোটি ৭১ লাখ ৯৩ হাজার ৬০০ টাকা তুলে নিয়েছে।তবে আলোচ্য বছরে রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশলীতা থাকায় প্রবাসি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের নতুন রের্কড গড়েছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। ২০১৪ সালের ১১ মাসে আগের বছরের চেয়ে লেনদেন ২ হাজার ২৩৮কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৩০২ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি ৮৮ লাখ ১৭ হাজার ৮৪৬ টাকায়। ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা ৩ লাখ ৪১ হাজার ১২৫টি বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। সিডিবিএলে’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বিও অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৯৪ হাজার ৯২৭টি। যা ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষ দিনে দাঁড়ায় ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৫২টি। অর্থাৎ ২০১৪ সালে বিও বেড়েছে ৩ লাখ ৪১ হাজার ১২৫টি। প্রতি মাসে গড়ে বিও বেড়েছে ২৮ লাখ ৪২৭টি।২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল ডিএসইতে টি প্লাস টু স্যাটেলমেন্ট সিস্টেম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। এতে লেনদেনের সময়সীমা ৪ দিনের পরিবর্তে কমে ৩ দিন হয়। কিন্তু এই সিস্টেম চালুর পরেও লেনদেনে গতি ফেরেনি। এরপর গত ১১ ডিসেম্বর ডিএসইতে নতুন সফটওয়্যার চালু হয়। নতুন সফটওয়্যার চালুর দিন থেকেই লেনদেনে বড় ধরনের হোঁচট খায় বাজার। ওইদিন ডিএসইতে ১৩৬ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়। এরপরে ডিএসইর লেনদেন বাড়লেও ২০০ কোটি টাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।নতুন সফটওয়্যার পরিচালনায় নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকারও ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) স্বপন কুমার বালা বলেন, তালিকাভুক্ত ব্রোকারেজ হাউজ, অপারেটর ও বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গাইড দেওয়া সম্ভব হয়নি তাই কিছুটা লেনদেনে সমস্যা হয়েছে। বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ডিএসই’র পিইরেশিও ছাড়া সব ধরনরে সূচকের উন্নতি হয়েছে। এর মধ্যে লেনদেনের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। আর সূচকের প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সব ধরণের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। নতুন বছরে বাজার স্থিতিশীল হবে বলে আশা প্রকাশ করেণ তিনি।এদিকে বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে হঠাৎ করেই পুঁজিবাজারে সূচক ও লেনদেন বেড়ে যায়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ডিএসই প্রধান মূল্য সূচক অবস্থান করে ৫ হাজার ৭৪ পয়েন্টে। যা ছিল এই বছরের রেকর্ড। এদিকে বছরের সর্বোচ্চ লেনদেন হয় ১৮ সেপ্টেম্বর। ওইদিন ডিএসইতে এক হাজার ২৮৮ কোটি ৫৫ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়।বিদায়ী বছরে ডিএসইতে বেড়েছে সূচক। আলোচ্য বছরে ডিএসইএক্স বা প্রধান সূচক ৫৯৮ পয়েন্ট বা ১৪ শতাংশ বেড়ে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৮৬৪ পয়েন্টে। আগের বছর একই সময়ে এই সূচকের অবস্থান ছিল ৪ হাজার ২৬৬ পয়েন্ট। ডিএস৩০ সূচক ৩৩৬ পয়েন্ট বা ২২ শতাংশ বেড়ে অবস্থান করছে ১ হাজার ৮০৩ পয়েন্টে।অন্যদিকে গত ১ বছরে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক ও লেনদেন দুটোই বেড়েছে। আলোচ্য বছরে সিএসইতে লেনদেন বেড়েছে ২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকার ৬০ শতাংশ। আলোচ্য বছরে সিএসই সার্বিক সূচক এক হাজার ৭৩৫ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ১৪ হাজার ৯৩৮ পয়েন্টে। আগের বছর একই সময়ে এই সূচকের অবস্থান ছিল ১৩ হাজার ২০২ পয়েন্ট। বছরের শেষ সময়ে এসে সিএসই বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের ওপর কমিশন চার্জ কমায়। যার সুফল লক্ষ্য করা যায় বাজারে। ফলে বছরের শেষদিক এস লেনদেন বাড়ে কয়েক গুণ। আলোচ্য সময়ে দেশের মধ্যে সমালোচনার শিকার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হওয়ার সনদ ও এ উপলক্ষে সংবর্ধনা দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনস (আইওএসসিও)। গোটা বছর জুড়ে দুই স্টক এক্সচেঞ্জে নানা সংস্কার কাজ হয়েছে। এর মধ্যে সিএসই ও ডিএসইতে শরীয়াহ সূচক চালু করা হয়। সংস্কারের অংশ হিসেবে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে গত ১৪ ফেব্রæয়ারিতে সাতজন স্বাধীন পরিচালক, চারজন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়ে ডিমিউচুয়ালাইজড স্টক এক্সচেঞ্জের প্রথম পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। আগের বছরের ২১ নভেম্বর স্টক এক্সচেঞ্জ হিসাবে আতœপ্রকাশ করে উভয় বাজার। যা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে। জটিল নিয়ম ও দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে আইপিওতে আবেদনের পদ্ধতিকে আরো সহজ করে ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে আইপিওতে আবেদনের পদ্ধতি শুরু হয় গত ২৮ সেপ্টম্বর থেকে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের সময় বাচে। একই সঙ্গে রিফান্ড জটিলতার পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে মুক্তি পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। দীর্ঘ ১৬ বছর পর লট প্রথা বাতিল করে অর্থাৎ খুচরা বিক্রির সুবিধা রেখে গত ১১ ডিসেম্বর থেকে ডিএসইতে নতুন সফটওয়্যারে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে লেনদেন ব্যবস্থা অটোমেশন ট্রেডিং সিস্টেম (ফ্লেক্স টিপি) চালু করা হয়েছে। ৩৫ কোটি টাকা খরচে চালু হওয়া সফটওয়্যারের ফলে নতুন বছরের এপ্রিল মাস থেকে বিনিয়োগকারীরা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে গোপন পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো জায়গা থেকে স্মার্টফোন, আইপ্যাড এবং অ্যাপস দিয়ে লেনদেন করতে পারবেন।এদিকে, জানুয়ারি মাসে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পুঁজিবাজার সংক্রান্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। হুমায়ুন কবিরকে বিচারপতি হিসাবেও নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বছর শেষ হলে কোনো মামলার কাজ এখনো শেষ হয়নি। এরপর মার্চে ডেরিভিটিভস মার্কেট, ক্লিয়ারিং করপোরেশন ও কমোডিটি মার্কেট প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কমিটি গঠন করে বিএসইসি। এ মাসেই পুঁজিবাজারের উন্নয়নে পাঁচ বছরের (২০১৪-২০১৮) মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য ১৪ দফা কর্মপরিকল্পনা তৈরী করে বিএসইসি। এরপর বিএসইসির তদারকিতে মে মাসে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের প্রথম কিস্তির ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় আইসিবি। আরো ৩০০ কোটি টাকা ছাড়ের অনুমোদন দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।বাজারের সার্বিক বিষয়ে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, ২০১৪ বছরটি ছিলো পুঁজিবাজারে ‘আন্তসংগঠনের বছর’। বাজার স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে এ বছর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে। পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জেকে লাভে আনতে পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করা হয়েছে। ফলে দৃশ্যমান পরির্বতন সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন তিনি। বিদায়ী বছরটাকে ‘মিশ্র প্রবণতার বছর’ বলে মনে করনে বাংলাদেশ মার্চেণ্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ এ হাফিজ। তিনি বলেন, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝ খানে রেখে বিদাই নিয়েছে বছরটি। ডিমিউচ্যুয়ালাইজড পুঁজিবাজার হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্ট সবার প্রত্যাশা ছিলো বাজারে স্থিতিশীল হবে। বছর শেষে তার কোনো আভাষও ছিলো না। এ জন্য দায়ি বিএসইসি, উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এ ছাড়াও গণহারে বিএসইসির আইপিও’র অনুমোদনের ফলে পুঁজিবাজারকে আরো অস্থিতিশীল করছে উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, এ বছরে কমিশন অযৌক্তি প্রিমিয়ামে অনেক প্রশ্নবিদ্ধ কোম্পানিকে বাজার থেকে অবাধে টাকা তুলে নেয়ার সুযোগ দিয়েছে। এ কারণে বাজরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
Advertisement