জঙ্গিরা আসে গোপনে, চুপিসারে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খুন করে পালায়। পুলিশ সারাদেশে জঙ্গি বিরোধি সাঁড়াশি অভিযানে ঘোষণা দিতে না দিতেই শুক্রবার ভোরে পাবনার হেমায়েতপুরে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পাণ্ডেকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিদিনের মতো ভোরে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে ছিলেন নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে। পাবনা মানসিক হাসপাতালের উত্তরপাশে প্রধান গেটে পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা পেছন থেকে তার ঘাড়ে ও মাথায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। সারাদেশে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলেই ধরে নিচ্ছে পুলিশ। গত ৫ জুন চট্টগ্রামে দুর্বৃত্তদের গুলিতে ঢাকার পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু (৩৫) নিহত হন। একই দিন নাটোরে দুর্বৃত্তরা খ্রিস্টান মুদি দোকানি সুনীল গোমেজকে (৬৫) কুপিয়ে হত্যা করে। এর দুদিন পর ৭ জুন ঝিনাইদহে আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে (৬৫) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এসব হত্যার রেশ না কাটতেই পাবনায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।দেশে জঙ্গিরা খুনের মহোৎসব শুরু করেছে। রাজনৈতিকভাবে নানা কিছু বলা যাবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে, বাংলাদেশকে বিশ্ব দরকারে অনিরাপদ প্রমাণ করতে, এখানে আইএস’র ঘাঁটি গড়তে দিতে এসব খুন হচ্ছে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে। সবকথা বিশ্বাস করার পরও মানুষ চায় ব্যবস্থা নেয়া হোক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই দাবি করুন না কেন, বাস্তবতা হলো মানুষ আজ আর শান্তিতে ঘুমাতে পারছেনা। সামগ্রিকভাবে জননিরাপত্তার অভাব তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছেড়ে দিবে কিনা দিনভর সেই হিসেব করছে। মৌলবাদীরা সংগঠিত হয়ে ক্রমবর্ধমান হারে ও লক্ষণীয় শক্তি নিয়ে বিশেষ কিছু ব্যক্তির ওপর হামলা করছে। ব্লগার, লেখক, প্রকাশক থেকে শুরু করে রাজপথে পাহারারত পুলিশ, পুলিশের পরিবার, এমনকি সামরিক বাহিনীর সদস্য। আরও আছেন শিয়া সম্প্রদায় আর মাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও। এসব কিছুর মাঝে মোটেও সংশ্লিষ্ট নন, এমন দুজন বিদেশি নাগরিকও প্রাণ হারিয়েছেন একই ধরনের হামলায়। ঘটনাগুলো পৃথক পৃথক স্থানে ও লক্ষ্যে। তবে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী। এ অবস্থায় ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এখন সিরিয়ার পরই বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নানা আক্রমণের খবর। সেই এক রাজিব হায়দার হত্যা ছাড়া একটি ঘটনারও কূলকিনারা করতে পারছেনা পুলিশ ও আইনশৃংখলা বাহিনী। ঠিক এমন বাস্তবতায় পুলিশ প্রধানের এই অভিযান পরিচালনার ঘোষণা এসেছে। জানান দিয়ে জঙ্গি দমন হয় কিনা, নাকি এতে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের আয়ের পথ সুগম হয়, সে নিয়ে বিতর্ক চলছে নানা স্তরে। মানুষ চায় অভিযান চলুক। প্রতিটি বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের যেন অভাব না থাকে। যেন পুলিশ সদস্যরা আন্তরিকভাবে কাজটি করেন। তবে এর মধ্যেই পাবনার আশ্রমের সেবায়েতের খুন বলে দেয় খুনিরা এসব অভিযানকে আসলে কোন পাত্তা দিচ্ছেনা। জঙ্গি দমনে পুলিশের দক্ষতা, সক্ষমতা ও সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে সরকারের সংবেদনশীলতা নিয়েও। সরকারের বিভিন্ন স্তরে ধরেই নেয়া হয়েছিল খুন হচ্ছে ব্লগার বা নাস্তিকরা। দুই বিদেশি হত্যার পর ধারণা করা গিয়েছিল টনক নড়বে। কিন্তু তা হয়নি। এখন পুলিশ কর্তার পরিবারের সদস্য খুনের পরও আবেগ বাদ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হবে কিনা সেই সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। সমস্যাটা শুধু আইনশৃংখলা জনিত নয়, বরং অনেকাংশেই তা রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবে কোন কর্মসূচি চোখে পড়ছেনা। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কিছু না কিছু উগ্রবাদী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলছে। উগ্রবাদ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে আনার কোনো রাজনৈতিক প্রচেষ্টাও লক্ষণীয় নয়। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। আওয়ামী ওলামা লীগের নেতারা বিভিন্ন সময় যা বলেছেন সেসব দাবি সম্ভবত পাকিস্তানেও এখন উচ্চারিত হয় না। এই সংগঠনটি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এর ঠিকানা ব্যবহার করে। অথচ দল আনুষ্ঠানিকভাবে বলছেনা যে এরা আওয়ামী লীগের কেউ নয়। দল সংশ্লিষ্ট দু’একজন ব্যক্তি অবশ্য বলেছেন, বলে চলেছেন। আবার দলের দু’একজন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তারাই এই ওলামা লীগের প্রতিপালক। মৌলবাদী শক্তি মোকাবিলা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল বলে মনে হয় না। বরং একটি বড় মৌলবাদী গোষ্ঠির সাথে নানা সমীকরণের কথাই বেশি শোনা যায়। আর ঠিক এ কারণেই পুলিশ বা আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে পরিষ্কার কোন বার্তা কখনোই রাজনৈতিকভাবে দেয়া হয়নি যে এরাই রাষ্ট্রের এখন এক নম্বর শত্রু। কঠিন রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সাফল্য লাভের সম্ভাবনা নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্ভব হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকর করা গেছে, এর পেছনে সরকার, বিশেষ করে তার শীর্ষ পর্যায়ে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার কাজ করেছে বলেই। আবার সেখানেই কিছুটা শিথিলতার কারণেই বা কোন কোন মহল থেকে প্রশ্রয় থাকায় কোন কোন মহল পরিস্থিতি গোলা করে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠিগত ফায়দা তোলার চেষ্টায় রত। এমন প্রশ্রয়ের প্রকাশ্য মহড়ার নজির দেখা গেলো নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক নির্যাতনের বেলায়ও। সমস্যাটি রাজনৈতিক। এই রাজনীতি দেশীয় রাজনীতি যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিকও। দেশীয় রাজনীতি এ কারণে যে, এই টার্গেট কিংলিং শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করতে গিয়ে। যারা আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ককে সামনে এনেছে তারাই হত্যা করছে, হত্যার সমর্থন দিচ্ছে, তারাই হেফাজতকে ঢাকায় এনেছিল, তারাই তাদের ডাকে সাড়া দিতে ঢাকাবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিল। এখানে রাজনীতি পরিষ্কার। আরেক রাজনীতি হলো বিশ্ব পরিমণ্ডলের। যুদ্ধবাজ দেশগুলো চায় বিশ্বব্যাপী তাদের মদদে সৃষ্ট আলকায়েদা, তালেবান ও আইএস’র প্রভাবকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক দেশ বাংলাদেশে নিয়ে আসতে। এমন বাস্তবতায় জঙ্গিবাদ নিয়ে সরকার তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্পষ্ট অবস্থান খুব জরুরি। কারণ তাদের অবস্থান অনেকটাই দোদুল্যমান। জঙ্গিদের পুলিশী চাপে রাখতেই হবে, তার কোন বিকল্প নেই। তবে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নিরসন সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়াতে হবে। এসব খুনিরা সংগঠিত আবার কোন কোন তরুণ জঙ্গি মতাদর্শে দিক্ষিত হয়ে ‘লিডারলেস’ জিহাদ শুরু হয়েছে। দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণের এখনই সময়। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট শুধু জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করছে। দীর্ঘ মেয়াদে এর সুফল হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু আশু করণীয় সব বাহিনীর কাজে সমন্বয়। বেশি প্রয়োজন শাসকদলের সব স্তরে কঠোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এইচআর/এমএস
Advertisement