বিশেষ প্রতিবেদন

কোথাও ঠাঁই নেই সাধারণ ক্রেতার

গত রোজার তুলনায় এবার বেশি পণ্য আমদানির পরেও ক্রমাগত বাড়ছে ছোলা, চিনি, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম। খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ স্বীকার করেছেন প্রতিকেজি চিনির মূল্য কোনোভাবেই ৬০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। অথচ খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায়। তবে খুচরা বাজারে দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পক্ষেও নন তিনি।এদিকে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন অজুহাতে সিন্ডিকেট করে নির্দিষ্ট মৌসুমে কিছু নির্ধারীত পণ্যের দাম আকাশচুম্বী করে তোলেন। দাম বাড়ার পেছনে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দোষারোপ করেন। আর এসবকিছু জেনেও গুটিয়েক ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। আবার মুক্তবাজার অর্থনীতি দোহাই দিয়ে বাজারে দাম নির্ধারণ করে দিতেও চায় না সরকার। তাহলে সাধারণ ক্রেতাদের ঠাঁই হবে কোথায়?সরকার খুচরা পর্যায়ে চিনির দাম বেঁধে দেবে কি না জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এটা করা যায় না। এটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজও না। এটা করলে কাজেও আসে না। তবে ভোক্তা অধিদফতরকে ‘বাজার মনিটরিং’ জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাই দেশের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো সমস্যার মুখোমুখি হলেই এক সংস্থা অন্য সংস্থার কাঁধে দায় চাপিয়ে দিতে চায়।মুক্তবাজার অর্থনীতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, মুক্তবাজার ব্যবস্থার সূত্রে মন্ত্রীর বক্তব্য ঠিক আছে। কিন্তু মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বাজারে পণ্য সরবরাহের পথ সবার জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের সেটা বিদ্যমান নেই। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী পুরো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম ইচ্ছা মাফিক নির্ধারণ করে। এতে করে ভোক্তার ক্ষতিগ্রস্ত হন।তাই মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্রে বাংলাদেশের জনগণ সুফল পান না। বাজার স্থিতীশীল রাখতে আমদানির ক্ষেত্রে আরো প্রতিযোগীর প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। ফলে বাজার একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। তখন মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল সাধারণ জনগণ পাবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।কিন্তু আমদানি চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রমজানের পণ্য মজুদ আছে ৪০ ব্যবসায়ীর গুদামে। সর্বোচ্চ পণ্য আমদানি করে বাজারের নিয়ন্ত্রণও নিজেদের হাতে রেখেছেন তারা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা ভোগ্যপণ্যের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ পণ্যই এখন রয়েছে এই ৪০ ব্যবসায়ীর কব্জায়।এসব ব্যবসায়ীর বেশিরভাগই ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহীর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাই রমজানের বাজার নিয়ে কারসাজি করছেন। অথচ গত ২৪ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে ব্যবসায়ীরা রমজানে দাম না বাড়ানোর অঙ্গীকার করেন।বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রমজানে ছোলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন সাত ব্যবসায়ী। ৫৬ ব্যবসায়ী এক লাখ ৬২ হাজার ৪৭৮ টন ছোলা আমদানি করেন। এ ছোলার ৭০ শতাংশই এনেছেন সাত ব্যবসায়ী। এর মধ্যে সর্বাধিক ৩৪ হাজার ৩৬৭ টন ছোলা এনেছে স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড। ২০ হাজার টন ছোলা এনেছে শেখ ব্রাদার্স। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে রুবি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড, লাকি ট্রেডিং, গাজী ট্রেডিং, বেঙ্গল ট্রেডিং ও ডিএন ট্রেডার্স।চার ব্যবসায়ীর কব্জায় চিনি। এবার সর্বাধিক দুই লাখ ৪৬ হাজার টন র সুগার এনেছে এস আলম গ্রুপ। দুই লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৫ টন এনেছে আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি। এক লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৩ টন র সুগার এনেছে সিটি গ্রুপ। ৫২ হাজার ৫০০ টন এনেছে ইউনাইটেড সুগার মিলস। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এক হাজার ৮২৭ কোটি ৩১ লাখ টাকায় সাত লাখ তিন হাজার ৭৪৮ টন চিনির কাঁচামাল আমদানি করেছে এ চার প্রতিষ্ঠান। এ হিসাবে প্রতি কেজি র সুগারের আমদানি মূল্য পড়েছে ২৬ টাকা। প্রতি কেজির প্রক্রিয়াজাত ব্যয় ১৪ টাকা যুক্ত করলে ব্যয় পড়ে ৪০ টাকা। অথচ বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায়।এদিকে ভোজ্যতেলের ৮০ শতাংশ মজুদ রয়েছে ১০ ব্যবসায়ীর হাতে। এ সময় চার লাখ ৮৫ হাজার ৬৫১ টন ত্রুক্রড সয়াবিন আমদানি করেছেন ১১ ব্যবসায়ী। এর মধ্যে বাংলাদেশ এডিবয়েল একাই আমদানি করেছে এক লাখ ৪৪ হাজার ৩১৫ টন। ৮০ হাজার ও ৭৮ হাজার টন ত্রুক্রড সয়াবিন এনেছে সুপার অয়েল রিফাইনারি ও তানভির অয়েল লিমিটেড। ২৬ ব্যবসায়ী ১২ লাখ ২২ হাজার ১৭ টন পরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি করেছে। এর ৭০ শতাংশ এনেছে আটটি প্রতিষ্ঠান। সর্বোচ্চ ২ লাখ পাঁচ হাজার ৬৪৬ টন ভোজ্যতেল এনেছে শবনম ভেজিটেবল অয়েল। বাকিগুলো হচ্ছে মেসার্স ইউনাইটেড এডিবয়েল, তানভির অয়েল, ফারজানা অয়েল, এস আলম ভেজিটেবল, বে-ফিশিং করপোরেশন, এস আলম সুপার ও ভিওটিটি অয়েল রিফাইনারি।এবার ৩৪টি প্রতিষ্ঠান ২৭ হাজার ৫০৪ টন ভেজা খেজুর আমদানি করে। এর ৬০ শতাংশই এখন মজুদ আছে মাত্র ১০ প্রতিষ্ঠানের কাছে। এগুলো হলো রয়েল ফ্রেশ ফ্রুটস, ইসলাম অ্যান্ড ব্রাদার্স, আল্লাহর দান ফ্রুট এজেন্সি, মদিনা ট্রেডিং, রামীসা এন্টারপ্রাইজ, জিতু ইন্টারন্যাশনাল, সিয়াম ফ্রুট কালেকশন, আরএম এন্টারপ্রাইজ, অ্যারাবিয়ান ডেটস ফ্যাক্টরি ও রাইসুল এন্টারপ্রাইজ। প্যাকেট খেজুর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ১৫টি হলেও ৭০ শতাংশই এককভাবে আমদানি করেছে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম।এছাড়া রমজানকে সামনে রেখে আমদানিকৃত মটর ডাল ও মসুর ডালের বেশিরভাগ এনেছে সিটি ডাল মিলস লিমিটেড, রুবি ফুড প্রোডাক্ট, জনতা ফ্লাওয়ার অ্যান্ড ডাল মিল লিমিটেড, শবনম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড, এমএইচ কনজিউমার প্রোডাক্ট লিমিটেড, হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স, এজে ট্রেডিং হাউস ও বেঙ্গল ট্রেডিং। এ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মোট ৬ লাখ ২০ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের ডাল আমদানি হয়।এমএইচ/এসকেডি/বিএ

Advertisement