২০১৫ সালকে বরণ করে প্রস্তুত পুরো বিশ্ব। আর মাত্র একদিন পরেই নতুন বছরের আগমন ঘটছে। বিদায় জানানো হবে ২০১৪ সালকে। ২০১৪ সালটি ফুটবলাঙ্গনে কেমন কেটেছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে খুব বেশি ফাইল-পত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে না। চোখ বন্ধ করেই বলা যাবে সবকিছু।বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৪দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ—আন্তর্জাতিক ফুটবলে ২০১৪ সালের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ও আলোচনার বিষয় ছিল বিশ্বকাপ ফুটবল। বছরের জুন মাসে লাতিন আমেরিকান ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিলের মাটিতে বসেছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের ২০তম এ আসর। ২ শতাধিক ফুটবল খেলুড়ে দেশগুলোর মাঝে থেকে বাছাই পর্বের মাধ্যমে সেরা ৩২টি দেশ নিয়ে শুরু হয়েছিল এই আসর।১২ জুন সাও পাওলোতে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৫ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং আসরের স্বাগতিক ব্রাজিলের ম্যাচ দিয়ে শুরু হওয়া ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ ১৩ জুলাই মারাকানা স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে জার্মানির ‘বিশ্ব জয়ের’ মধ্য শেষ হয়।জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ের পাশাপাশি এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্য ছিল-গ্রুপ পর্ব থেকেই আগের আসরের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনের লজ্জাজনক বিদায়ের পাশাপাশি সাবেক ২ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড ও ইতালির বিদায়; নকআউট পর্বের খেলায় ইতালির জিওরজিও চিল্লানিকে কামড়ে দিয়ে উরুগুয়ের তারকা স্ট্রাইকার লুই সুয়ারেজের নিষিদ্ধ হওয়া, মেসি-রোনালদো-নেইমার-রোবেন-মুলালের মতো তারকা ফুটবলাদের পিছনে ফেলে কলম্বিয়ার তরুণ ফুটবলার জেমস রদ্রিগেজের সেরা গোলদাতার (৬ গোল) পুরস্কার গোল্ডেন বুট জিতে নেওয়া, সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে ব্রাজিলের অবিশ্বাস্য হার, ব্রাজিলের সাবেক ফরোয়ার্ড রোনালদোকে পিছনে ফেলে জার্মানির মিরাস্লাভ ক্লোসার বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়া।শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক বিতর্কই যুক্ত হয়েছে এবারের বিশ্বকাপে। এর মধ্যে বিশ্বকাপ আযোজনের বিপক্ষে ব্রাজিলের সাধারণ জনগণের একটি অংশের তীব্র প্রতিবাদী আচরণ, বিশ্বকাপ প্রস্তুতির প্রাক্কালে বিভিন্ন কারণে ৬ শ্রমিকের মৃত্যু, একটি নির্মাণাধীন ব্রিজ ধসেপড়া, গ্রুপ পর্বে ১৮ জুন স্পেন-চিলি ম্যাচ চলাকালে চিলি সমর্থকদের দ্বারা মারাকানা স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টার ভেঙে ফেলা ইত্যাদি বিতর্কগুলো ব্রাজিল বিশ্বকাপের সৌন্দর্য কেড়ে নেয় অনেকাংশেই।সরগরম ক্লাব ফুটবলে রিয়ালের বছর :বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ফুটবলকে সরগরম করে রেখেছে ক্লাব ফুটবল। বছর শুরু হয়েছিল স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে। আসরের নাটকীয় ফাইনালের অতিরিক্ত সময়ের খেলায় আরেক স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ১০ম বারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিতে রিয়াল মাদ্রিদ। শুরুর মতো রিয়ালের বছরটা শেষও হয়েছে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে। মাঝে স্প্যানিশ কোপা দেল রে এবং স্প্যানিশ সুপার কাপের শিরোপা ঘরে নিয়েছে কার্লো আনচেলিত্তোর দল। রিয়ালের মতোই এই বছরটা নিজেদের করে নিয়েছে জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ। মাঠের খেলায় জার্মান বুন্দেসলিগাসহ একাধিক শিরোপা ঘরে নিয়েছে পেপ গার্দিওলার দল। ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিও এ বছর সাফল্য পেয়েছে মাঠের খেলায়; জিতেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলের শিরোপা। স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের জন্য বছরটি নব উত্থানের বছর হিসেবেই বিবেচিত হবে। এ বছর স্প্যানিশ লা লিগা শিরোপা ঘরে নিয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রানার্সআপ দলটি।তবে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা কিংবা ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য বছরটি হতাশার হয়েই থেকেছে। এ বছর কোনো শিরোপা জিততে পারেনি বার্সেলোনা। অন্যদিকে, ম্যানইউ যেন হারিয়ে ফেলেছে ফুটবলের ছন্দ!রেকর্ডময় বছর :আন্তর্জাতিক ফুটবল কিংবা ক্লাব ফুটবল-২০১৪ সালে বিশ্ব ফুটবলে লেখা হয়েছে অনেক নতুন রেকর্ড। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে বলতে হয়, জার্মানির মিরাস্লাভ ক্লোসে লিখেছেন বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা গোলদাতার রেকর্ড, ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে লিওনেল মেসির পায়ের জাদুতে লেখা হয়েছে দু’টি নতুন রেকর্ড; এর একটি স্প্যানিশ লা লিগায় এবং অন্যটি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। দু’টি ক্ষেত্রেই সর্বকালের সেরা গোলদাতার রেকর্ড গড়েছেন মেসি। মেসির সতীর্থ অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া গড়েছেন আরেকটি নতুন রেকর্ড। ইংলিশ ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ট্রান্সফার ফি’র রেকর্ড গড়ে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছেন মারিয়া। পর্তুগিজ ফুটবল সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জন্ম দিয়েছেন সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকের (২৩) রেকর্ড।মেসি-রোনালদো দ্বৈরথঃবিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম আলোচিত ও আকর্ষণের বিষয় হয়ে ছিল লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। বিশ্বকাপের পারফরমেন্সে রোনালদোকে পিছনে ফেলেছেন মেসি। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে রোনালদোর পেছনে পড়তে হয়েছে তাকে। বিশ্বকাপে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার জিতলেও ক্লাব ফুটবলে একাধিক পুরস্কার নিজের ঘরে নিয়েছেন রোনালদো। আর্জেন্টিনা কিংবা বার্সেলোনা-কোনো দলকেই কোনো শিরোপা জেতাতে পারেননি মেসি। অন্যদিকে, নিজ দেশ পর্তুগালকে সাফল্য উপহার দিতে না পারলেও স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদকে একাধিক শিরোপা জিতিয়েছেন রোনালদো। মেসিকে হারিয়ে বছরের শুরুতে ফিফা ব্যালন ডি’ওর পুরস্কারও জিতেছেন রোনালদো।রেকর্ডের ক্ষেত্রেও এ বছর তীব্র প্রতিযোগিতা করেছেন এই দুই ফুটবল সুপারস্টার। মেসি যখন স্প্যানিশ লা লিগা ও উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বকালের সেরা গোলদাতার রেকর্ড নিজ দখলে নিয়েছেন, রোনালদো তখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকের রেকর্ড দখল করেছেন। শুধু তাই নয়, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতার জায়গাতেও নিজের নাম লিখে নিয়েছেন তিনি।অবসরের বছর :বিশ্ব ফুটবলে প্রতি বছরের মতো ২০১৪ সালটা যেন পরিণত হয়েছে তারকা ফুটবলারদের অবসরের বছরে। বিশ্বকাপ শেষেই এই অবসরের মিছিল শুরু হয়েছে। জার্মানি বিশ্বকাপ জিতে নেওয়ার পর পরই আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে দেন অধিনায়ক ফিলিপ লাম। একই পেথে হেঁটেছেন বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা গোলদাতার রেকর্ডধারী বর্ষীয়ান জার্মান ফুটবলার মিরাস্লাভ ক্লোসা ও একই দলের পার মার্তেস্কার। এরপর অবসেরর তালিকা একে একে দীর্ঘ করেছেন নেদারল্যান্ডসের ডার্ক কুইট, আইভরি কোস্টের দিদিয়ের দ্রগবা, ইংল্যান্ডের রায়ান গিগস, স্পেনের কার্লোস পুয়ল, যুক্তরাষ্ট্রের ল্যান্ড ডনোভান, ফ্রান্সের ফ্রাঙ্ক রিবেরি, একই দেশের থিয়রি অঁরি, এরিক আবিদালসহ অনেক তারকা ফুটবলার।আলোচনায় পেলে এবং ম্যারাডোনাঃবছরের শুরু থেকে শেষ অবধি ঘন ঘনই সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের দুই কিংবদন্তি। বিশ্বকাপে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ধারাভাষ্যকার হিসেবে আলোচনায় এসেছেন ম্যারাডোনা। এ ছাড়া প্রেম সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনাও আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বরকে আলোচনায় এনেছে বিভিন্ন সময়ে। অন্যদিকে, ব্রাজিলের ‘কালো মানিক’ অসুস্থতাজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আলোচনায় এসেছেন বছর শেষের দিকে।দুর্নীতি, তারকার মৃত্যু, শান্তি কামনা আর নব আসরঃ২০১৪ সালে বিশ্ব ফুটবলের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ নির্ধারণে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার বিরুদ্ধে আনীত ঘুষ গ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক, বর্ণবাদ ও ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা, আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ফুটবলার আলফ্রেদো ডি স্টেফানো ও পর্তুগিজ কিংবদন্তি ইউসেবিও ডি সিলভা এবং ইংল্যান্ডের অন্যতম গ্রেটেস্ট ফুটবলার টস ফিনের মৃত্যু।দুর্বৃত্তদের গুলিতে অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ২৭ বছর বয়সী সেঞ্জে মেইওয়ার নিহত হওয়ার ঘটনা।বিশ্ব শান্তির জন্য পোপ ফ্রান্সিস আয়োজন করেন “আন্তঃধর্মীয় শান্তির ফুটবল ম্যাচ”। যে ম্যাচে খেলেছেন ম্যারাডোনা, জিদান, রবার্তো ব্যাজিওদের মতো সাবেক ফুটবল গ্রেটরা।প্রথমবারের মতো ভারতে ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক ফুটবল আসর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইএসএল’র আয়োজন এবং তাতে সৌরভ গাঙ্গুলি, শচিন টেন্ডুলকারদের মতো সাবেক ক্রিকেট গ্রেটদের পাশাপাশি মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট কোহলির মতো বর্তমান ক্রিকেটার ও অভিষেক বচ্চন, হৃতিক রোশান, রনবীর কাপুরদের মতো বলিউড তারকাদের ফুটবল দলের মালিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা।
Advertisement