আমি হলফ করে বলতে পারি, এই অনুভূতি আমার একলার হচ্ছে না। আরও অনেকের হচ্ছে। ভদ্রলোক দুইটা বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। এসকেপিং টেনডেন্সির কারণে হতে পারে, আমি কাল সারাদিন এই ছবি দেখি নাই বা এ সংক্রান্ত আহাজারি পড়ি নাই কিছু। সারাদিন, প্রায় সারাদিন এক পরিচিতর সাথে অনলাইনে কথা বলেছি। অন্য কারণ তো ছিলই কিন্তু একটা কারণ হলো নিজেকে ভুলিয়ে আর ব্যস্ত রাখা। আজ সকালে মেয়েকে নামাতে গেলাম স্কুলে, গাড়ির মধ্যে বারবার গা ঘেঁষে আসছিল সে আমার। মাড়ি বের করে হাসছিল।তখন থেকে বুকের ভেতর ধকধক। তারপর অফিসে এসে আজ ছবিগুলো দেখলাম। একটা টিভিতে বাবুল আক্তারের কাজের সময়ের বিভিন্ন ছবি দেখাচ্ছিল। অতি সাধারণ চেহারার পাশের বাড়ির একটা ছেলে, বীরের যে চেহারা আমাদের কল্পনায় থাকে সেরকম কিছু নয়। স্ত্রীর জানাজায় কান্নায় ভেঙে পড়া ছবি দেখাচ্ছিল। মুত্যুগুলো কোথাও খুব একরকম। দীপন ভাইয়ের বউ যেমন জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে কথা বলেছিলেন স্বামীর লাশের সাথে...। নিয়মিত বিরতিতে খুন হওয়াটা এবং মেনে নেয়াটাও পুরোন হয়ে গেছে অনেক আগেই। পেন্সিলে আঁকা আমাদের আহাজারির স্মৃতির উপর বিস্মৃতির রবার ঘষা শুরু হলো বলে। জাস্ট দুচারটা দিন। মিতু কে? সাধারণ একটা গৃহবধূ। সুন্দর গোলগাল চেহারার, স্বামীর পদোন্নতি হচ্ছে, সে ঢাকায় গেছে অফিসের কাজে, বাচ্চা দুইটাকে নিয়ে সচ্ছল আর সুখী পরিবারের ছবি। আমি নিউজের কাজে উত্তরায় এক পুলিশ অফিসারের বাসায় গিয়েছিলাম একবার। ভদ্রলোক থানায়, তার স্ত্রী রান্না বান্না করে এলাহী কারবার করেছে, বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তিত। শিক্ষা সংক্রান্ত একটা নিউজের কাজেই গিয়েছিলাম। টেবিলভর্তি খাবারের আয়োজন দেখে আমি বিব্রত, সেই ভদ্রমহিলা আমার বিব্রতভাব দেখে আরও বিব্রত। বললেন, আপা, "আমাদের সবাই সামাজিক ভাবে নানান কথা বলে, ঘুষের চাকরী, এইটা -সেইটা, আপনি আবার খাবার না খেয়ে চলে যাবেন না তো?"কথা তো মিথ্যা না। ঘুষের চাকরী। কিন্তু আমি ভদ্রমহিলার মধ্যে অগুনতি সাধারণ গৃহবধূর মুখই দেখি। আপনার পুরো সমাজ নানাভাবে পচবে আর পুলিশ, সাংবাদিক এরা খুব সততার পরাকাষ্ঠা হবে এমন আশা করাও তো বেঠিক। যাই হোক, আমি খেয়েছিলাম। আজ মিতুর ছবির দিকে তাকিয়ে ঐ ভদ্রমহিলার কথা মনে পড়ছে। অভিজিত রায় মারা যাওয়ার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গোপনে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর বাবার সাথে। সেইসময় আমাদের কোনো গণমাধ্যম বা সুশীল সমাজ তেমন জোরালোভাবে প্রশ্ন তোলেননি, কেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন খুন হওয়া সন্তানের পিতার সাথে গোপনে দেখা করতে গেলেন? অথচ তার আগের বছরেই তো রাজীব হায়দারের মৃত্যুর পর তিনি গিয়েছিলেন মিরপুরে তাঁর বাড়িতে। একবছরে কি পাল্টে গেল? কেন পাল্টে গেল? পাল্টে যাওয়ার কারণগুলিকে শক্ত হাতে দমন করতে পারলো না কেন আমাদের "সেক্যুলার" গভর্মেন্ট? পারেন নাই যে তারই ফলাফল মাহমুদা মিতু। দেশে আইএস আছে বললে পশ্চিমারা ঝাঁপিয়ে পড়বে এরকম বক্তব্যও আমরা শুনেছি। বেশ। ঐটা বায়বীয়। কিন্তু খুনগুলো তো স্পষ্ট, বিচার হচ্ছে না সেটাও স্পষ্ট। বিচার করার ইচ্ছা আছে কি না সেটা এখন স্পষ্ট হওয়া দরকার। হবে না বললেও যে আমরা হতাশ হয়ে "ঠিক আছে, আর বিচার চাইবো না" বলে হাল ছেড়ে দেবো তা ভাবার কোনো কারণ নেই। কেউ না কেউ কিন্তু মাথা তুলেই যাবে। আরও সিগনেফিকেন্ট হলো, এই ঘটনার সাথে সাথে নারীরা আক্রান্ত হওয়া শুরু হলো। এরপরের টার্গেট কি শিশুরা?এইবেলা প্রিয় প্রশাসন এবং সরকার, স্বীকার করে নেন যে, ঘটনাগুলো একই সূতায় গাঁথা। বাবুল আক্তার যাদের রোষের শিকার তারা বায়বীয় নয়, বরং আপনাদের চেয়ে অনেকবেশি গোছানো, অনেকবেশি দক্ষ। ঐ সাধারণ চেহারার মানুষটি যে তার ডিউটি করতে গিয়ে এত বড় ক্ষতির মুখে পড়লো তার সাথে প্লিজ বেঈমানী করবেন না।লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, ডিবিসি নিউজএইচআর/পিআর
Advertisement