অপরাজেয় বাংলাদেশের শেল্টার হোমে আশ্রয় পাওয়া বেশির ভাগ শিশুর জন্মই জামালপুর যৌনপল্লীর অন্ধকার ঘরে। ভদ্র সমাজে ঠাঁই না পাওয়া এসব শিশুদের একমাত্র আশ্রয়স্থল এই শেল্টার হোম। এসব শিশুদের শিক্ষা, বিনোদন, আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি প্রতিটি শিশুর জন্য তিনবেলা খাবারে বরাদ্দ মাত্র ১৪ টাকা! সেটাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। আর্থিক সংকটের কারণে দাতাসংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশকে সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় অজানা আশঙ্কায় দিন পার করছে শেল্টার হোমে আশ্রয় পাওয়া শিশুসহ তাদের মায়েরা। পিংকি, রিমি, ঝুমা, সুমি, কবির (ছদ্মনাম) সবার জন্মই জামালপুর যৌনপল্লীর অন্ধকার গলিতে। শুধু এরাই নয় যৌনপল্লীর অন্তত ৩৫ জন শিশুসহ জামালপুরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন ও শোষণের শিকার ২০৭ জন শিশুর আশ্রয় এখন অপরাজেয় বাংলাদেশের শেল্টার হোম। ভদ্র সমাজ ঠাঁই না দিলেও যৌনপল্লীর অন্ধকার গলিতে জন্ম নেয়া এসব শিশুরা স্বপ্ন দেখে চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিংবা পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে সমাজে অবদান রাখার। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অন্ধকার জগতের নরক থেকে গর্ভধারী মাকে উদ্ধার করে নতুন পরিচয় দেবার রঙিন স্বপ্ন বুনন করছে এই শিশুরা। কিন্তু নিজেদের আর্থিক সংকটের কারণে ইতালীয় দাতাসংস্থা টেরি ডেস হোমসের সহায়তা বন্ধের ঘোষণায় শেল্টার হোমে আশ্রিত শিশুদের সেই রঙিন স্বপ্ন আজ ফিকে হতে চলেছে।জানা গেছে, ২০০২ সাল থেকে টেরি ডেস হোমসের আর্থিক সহায়তায় জামালপুরের যৌনপল্লী ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন ও শোষণের শিকার শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের কাজ করে আসছে অপরাজেয় বাংলাদেশ। বর্তমানে অপরাজেয় বাংলাদেশের শেল্টার হোমের আবাসিকে যৌনপল্লীর ৩৫ জন এবং অনাবাসিকে বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন ও শোষণের শিকার ১৭২ জন শিশুকে নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ, গান ও সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। দাতাসংস্থা টেরি ডেস হোমস অপরাজেয় বাংলাদেশকে বিভিন্ন খরচের বাইরে প্রতিটি শিশুর তিনবেলা খাবারের জন্য সকালে ৪ টাকা, দুপুরে ৫ ও রাতে ৫ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। যা দিয়ে শিশুদের তিনবেলা খাবার দেয়া অসম্ভব। তাই যৌনপল্লীর মা এবং শহরের কিছু বিত্তবানদের কাছ থেকে মাঝে মধ্যে আর্থিক সহায়তা নিয়ে কোনো রকমে এই শিশুদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিচ্ছে অপরাজেয় বাংলাদেশ। কিন্তু চলতি বছরের ডিসেম্বরে দাতাসংস্থার আর্থিক সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে শেল্টার হোমের শিশুদের খাবারের ১৪ টাকার সঙ্গে তাদের আবাসন ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে এসব শিশুদের স্বপ্ন গুটিয়ে ফিরে যেতে হবে যৌনপল্লীর অন্ধকার জগতে। শেল্টার হোমের শিশু সুমি আক্তার (ছদ্মনাম) যৌনপল্লী থেকে দুই বছর বয়সে এই শেল্টার হোমে এসেছিল। এখন সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। লেখাপড়ে করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অন্যসব মায়েদের মতোই নিজের মাকেও সসম্মানে রাখার স্বপ্ন দেখে সুমি। আর কবির (ছদ্মনাম) জানায়, মাকে খারাপ জায়গা থেকে নিয়ে আসতে হলে ভালোভাবে পড়াশুনা করতে হবে তাকে। সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে সে। এই স্বপ্ন পূরণে তার পাশে রয়েছে অপরাজেয় বাংলাদেশ।শেল্টার হোমে থাকা যৌনপল্লীর শিশুদের মায়েরা অন্ধকার জগতে বাস করলেও সন্তানদের নিয়ে তারা দেখেন বড় স্বপ্ন। বর্তমানে অপরাজেয় বাংলাদেশের সহযোগিতায় যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া তিনজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বেশ কয়েকজন বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করছে। আর তাদের অনুসরণ করে বাকি শিশুদের মায়েরা সন্তানের আগামী ভবিষ্যত নিয়ে আশায় বুক বাধছে। কিন্তু সন্তানদের আশ্রয় এবং খাবারের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আজ তারা শঙ্কিত। সন্তানরা যেন তাদের মতো অন্ধকার জগতে ফিরে না আসে বিত্তবানসহ সরকারের কাছে এমনই প্রত্যাশা করেন তারা। যৌনকর্মী রিক্তা ও সেতু (ছদ্মনাম) জানায়, পেটের দায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা এই খারাপ পেশাকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের সন্তানদের একই পথে আনতে চান না তারা। সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে নিজের কষ্ট ভুলে যেতে চান।জামালপুর অপরাজেয় বাংলাদেশের শেল্টার ম্যানেজার মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বরে দাতাসংস্থা আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলেও অপরাজেয় বাংলাদেশ নিজস্ব তহবিল দিয়ে এই শেল্টার হোম চালিয়ে নিবে।তবে বর্তমানের মতো বৃহৎ আকারে চালানো হয়তো সম্ভব হবে না, সেটা সীমিত আকারে চালানো হবে। এক্ষেত্রে সরকারসহ বিত্তবানরা এগিয়ে আসলেেশেল্টার হোমটি স্বাভাবিকভাবেই চালানো সম্ভব হবে। আর তা করা গেলে এসব শিশুদের কাউকেই তাদের মায়েদের মতো অন্ধকার জগতে ফিরে যেতে হবে না। জামালপুর শিশু সুরক্ষা নের্টওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, একটি শিশুর জন্য তিনবেলা খাবার বাবদ মাত্র ১৪ টাকা বরাদ্দ এটি অত্যন্ত অমানবিক। তারপরও জেলার একমাত্র শেল্টার হোমে এই শিশুরা নিরাপদে থাকতে পারছে। এখন যদি এটি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে শিশুদের ভবিষ্যতও অন্ধকারে পতিত হবে। তাই আমাদের দাবি, যেভাবেই হোম এই শেল্টার হোমটি টিকিয়ে রাখতে হবে। জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. রাসেল সাবরিনবলেন, এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের সুযোগ যদিও সীমিত তারপরও এসব শিশুদের সুরক্ষায় সমাজের বিত্তবানদের পাশে দাড়ানোর আহ্বান জানান। এসএস/পিআর
Advertisement