অর্থনীতি

মিশ্র অর্থনীতির বছর গেলো-২০১৪

২০১৪ সাল ছিল অর্থনীতির মিশ্র ফলাফলের বছর। আর্থিক খাতের বেশির ভাগ সূচকের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও অবকাঠামো ও রাজস্ব আহরণের গতি বাড়ানোর সুযোগ ছিল। এ দুটো দিকে ২০১৫ তে জোর নজর দিতে হবে। ২০১৩ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল ও অবরোধ সামগ্রিক অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। এজন্যে ২০১৪ এর বড় অংশ জুড়ে বিনিয়োগ স্থবিরতা ছিল আলোচিত বিষয়। এসব কারণে বছরের শুরুতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রশ্নে কিছুটা অনিশ্চয়তা লক্ষ্য করা গেছে। তবে গেল বছরের শেষের দিকে বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির ধারা জোড়ালোভাবে ফিরে এসেছে। বিশেষ করে স্থানীয় বাজারে টাকা ও ডলার মার্কেটে বাড়তি তারল্য কমে আসার যে লক্ষণ দৃশ্যমান তাতে মনে হয় ব্যবসা-বাণিজ্য আড়মোড়া ভেঙ্গে চাঙ্গা হচ্ছে। এমন তথ্য ওঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৪ সালের অর্থনীতি নিয়ে তৈরি করা এক প্রতিবেদনে।বাংলাদেশ বলছে, ভোক্তা ও ব্যবসায়িক আস্থায় এসেছে নতুন গতি। তার ঊর্ধ্বমুখী ঢেউ লেগেছে আমদানি ও রপ্তানিতে। বেড়েছে বিদেশ থেকে অর্থ প্রেরণের মাত্রা। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে সৃষ্টি হয়েছে নতুন রেকর্ড। ২০১৪ অর্থবছরের প্রায় অর্ধেক সময় জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিগত এই অর্থবছরে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়। মাথাপিছু আয় ২০১৩ অর্থবছরের ১ হাজার ৪৪ ডলার থেকে বেড়ে ২০১৪ অর্থবছরে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৯০ ডলারে। আরো লক্ষ্যণীয় ছিল মূল্যস্ফীতির নিম্নগতি। যদিও এই নিম্নগতি ছিল ধীর, তবু ক্রমাগত মূল্যহ্রাস ভোগ ও বিনিয়োগকে উদ্বুদ্ধ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহে যথেষ্ট সতর্ক অবস্থানে ছিল বলেই প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সন্তোষজনক সংখ্যা বেরিয়ে এসেছে।জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান জাগোনিউজকে বলেন, ২০১৪ এর শেষ পর্বে অভ্যন্তরীণ চাহিদার যে নতুন প্রণোদনা সৃষ্টি হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে ২০১৫ এর অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বা তদূর্ধ্ব প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ অর্জন হতে পারে। তবে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি থাকবে। এর কারণ বিবিধ-সরকারি নতুন বেতন কাঠামো, মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতায় তেলের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা ও চাহিদাতাড়িত ঊর্ধ্বচাপ। এগুলো মাথায় রেখেই বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মুদ্রানীতি সাজাবে, যাতে ২০১৫ এর অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি অর্জন করা সম্ভব হয়। তিনি আরো বলেন, আর্থিক খাতে সুশাসন ও ঋণ শৃঙ্খলা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিনিয়োগ আস্থাকে আরো চাঙ্গা করবে। এরই মধ্যে সংশোধিত ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের বলে প্রধান নির্বাহী অপসারণ এবং পাশাপাশি দক্ষদের সুরক্ষা প্রদান এবং পর্ষদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ সবই করা হয়েছে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বাড়ানোর লক্ষ্যে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি হবে ২০১৫ এর জন্যে আর্থিক খাতের অন্যতম লক্ষ্য। আর তা করা হচ্ছে বলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বাড়ছে। এর সঙ্গে বহির্বাণিজ্যের প্রসার যেভাবে ঘটছে তাতে মনে হয় নতুন এই বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।অর্থবছর ২০১৪ এর ৩৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় ২০১৫ অর্থবছরে যথাক্রমে ১২ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রপ্তানি বৃদ্ধিতে অনুরূপ গতি সারা বছর লক্ষ্য করা না গেলেও বছর শেষে রপ্তানির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রদর্শন করেছে। বিদেশ থেকে অর্থ প্রেরণের পরিমাণেও ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটতে পারে। ২০১৪ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান মজুদ ২২ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে সাত মাসের মতো আমদানি ব্যয় নির্বাহ সম্ভব। গত বছর ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪ এর শেষ দিকে আমদানির উপাদানে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বেড়েছে পুঁজিদ্রব্য ও যন্ত্রপাতির আনুপাতিক মাত্রা যা অর্থনীতির ভবিষ্যৎ ক্ষমতায়নে ব্যবহৃত হবে। আমদানি সিংহভাগ মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল হওয়ায় চলতি হিসাবের সহনীয় পর্যায়ের বর্তমান সামান্য ঘাটতি ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে বেগবান করবে বলে আশা করা যায়।সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৌশলের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করেছে কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। এগুলো হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই)-এর জন্যে ঋণ, গ্রীন ব্যাংকিং, আর্থিক খাতের আধুনিকায়ন, ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং, কৃষি ঋণ সম্প্রসারণ, রপ্তানি উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন উদারিকরণ। জনগোষ্ঠীর সবাইকে জাতীয় উৎপাদনের শামিল করা এবং দরিদ্রের ক্ষমতায়নই হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের মূলমন্ত্র। অর্থনীতি এর সুফল ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। জীবনের আয়ুষ্কাল, দারিদ্র্যের হার, প্রকৃত মজুরির মতো অনেক সূচকেই ইতিবাচক পরিবর্তন চোখে পড়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রথমবারের চাল রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থনীতিতে বেড়ে যাচ্ছে সেবা ও শিল্প খাতের আনুপাতিক অবদান যা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে দেবে শক্তি ও দ্রুতি। ২০১৪ এর চালচিত্রে কিছু অস্বস্তিকর দিকও লক্ষ্যণীয়। তার মধ্যে খেলাপি ঋণ, বিনিয়োগ মন্থর হওয়ার কারণে তারল্য বৃদ্ধি, শাখা পর্যায়ের ব্যাংকে কিছু অনিয়ম প্রচার মাধ্যমে ওঠে এসেছে। অবশ্যিক, এগুলোর অধিকাংশই ২০১৩ এর হরতাল-অবরোধ বা রাজনৈতিক অস্থিরতার বিলম্বিত মাসুল। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশোধনমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে এই নেতিবাচক প্রবণতা লাঘবে সচেষ্ট হয়েছে। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবং শ্রেণীবিন্যাস ও প্রভিশনিং বিশ্বমানের করার কারণে খেলাপি ঋণের হার এককালীন উল্লম্ফন হয়েছিল। প্রভিশন সংস্থান না করা নিট খেলাপি ঋণের মাত্রা মোট ঋণের নিম্নতর একাংক শতাংশেই পরিমিত রয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ে আরো মনোযোগী হতে ক্রমাগত নির্দেশ দেয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী নীতি প্রণয়নের কারণে খেলাপি ঋণের হার কমতে শুরু করেছে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকেও বেশ খানিকটা চাপ নিতে হয়েছে। এ দিকটায় বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো রকম ছাড় দেবে না। অবশ্যই ব্যাংকগুলোকে সর্বক্ষণ গুণমানের ঋণ দেবার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। নিয়ম-নীতি সংস্কার করে হয়তো ভালো গ্রাহকদের কিছুটা সুবিধা দেয়া হতে পারে। কিন্তু মন্দ গ্রাহকদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে দ্বিধা করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ বলছে, উদ্বৃত্ত তারল্য এখন নিম্নমুখী। কলমানি রেট আগস্টে বিদ্যমান ৬ ভাগ থেকে বেড়ে বছর শেষে ৮.৩ ভাগে উঠেছে। এই সহনীয় ঊর্ধ্বগামিতাই প্রমাণ করে মুদ্রাবাজারে শৈথিল্য প্রায় অনুপস্থিত। ব্যবসার প্রসারণে চাঙ্গা হচ্ছে তহবিল চাহিদা। বিভিন্ন ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী এই উভয় প্রবাহেরই গতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ২০১৫ তে বর্ধিত আমদানি চাহিদার সংকেতবহ। বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারসহ নজরদারি আরো জোরদার করেছে যাতে অনুরূপ ব্যাংকিং অনিয়মের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। প্রাসঙ্গিক ড্যাশবোর্ড চালু করে নজরদারির গুণমানে ব্যাপক উন্নতি আনা হয়েছে।

Advertisement