বিশেষ প্রতিবেদন

সক্রিয় ২০ জঙ্গি সংগঠনের নিষিদ্ধ মাত্র ৬টি

বাংলাদেশে কমপক্ষে অর্ধশত উগ্রবাদ ও জঙ্গি সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কার্যক্রম চলছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যে উঠে আসলেও এর মধ্যে নিষিদ্ধ মাত্র ৬টি সংগঠন। সক্রিয় কার্যক্রম চালাচ্ছে কমপক্ষে ২০টি সংগঠন। যে ৬টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলোর কর্মকাণ্ডও পুরো বন্ধ হয়নি। বরং নিষিদ্ধগুলোই বেশি সক্রিয়।প্রতিষ্ঠার পর থেকে র‌্যাব মোট ১ হাজার ১৮১ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছে। র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতারকৃতরা ১৬টি সংগঠনের। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও ১৪ সংগঠনের হাজারেরও বেশি জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে। অথচ এরপরও নিষিদ্ধ মাত্র ৬টি জঙ্গি সংগঠন।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অনেকেই জামিনে বেরিয়ে একইভাবে জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকে জড়িত লিস্টেট ব্যক্তিদের খুনে। জামিনে বেরিয়ে যাওয়া জঙ্গি সদস্যদের সঠিক নজরদারিও চলছে না বলে দাবি অপরাধ বিশেষজ্ঞদের।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, বিগত জোট সরকারের আমলে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে শাহাদত-ই-আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ (হুজি), জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করা হয়। মহাজোট সরকারের আমলে ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিজবুত তাহরিরকে নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়াও আরো প্রায় অর্ধশত সংগঠনের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পুলিশ-র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। ওই সময় গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করে, ছদ্মনাম ব্যবহার করে জঙ্গি নেতারা সংগঠনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালাচ্ছে।২০১৩ সালের জুনে বরগুনার দক্ষিণ খাজুরতলা এলাকা থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ ৩১ জঙ্গি গ্রেফতার হয়। তাদের সহযোগীদের ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলায় অভিযান চালিয়ে হিটলিস্ট উদ্ধার করা হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে গোয়েন্দা বাহিনী।২০১৩ সালে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখায় সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনের একটি তালিকা দেয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আল্লাহর দল, ইসলামিক সলিডারিটি ফ্রন্ট, তামীরউদ্দীন বাংলাদেশ, তৌহিদী ট্রাস্ট, হিজবুত তাওহিদ, শাহাদত-ই-নবুয়ত ও জামাত-আস-সাদাত নিষিদ্ধ করার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়।সে অনুযায়ী ওই বছরের ২৬ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ৮টি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। তবে এর মধ্যে শুধু মাত্র আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে (এবিটি) নিষিদ্ধ করা হয়। বাকিগুলোকে নজরদারিতে রাখার সিদ্ধান্ত হয়।বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সবচেয়ে সফল সংগঠন এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র‌্যাব সূত্র জানায়, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে র‌্যাব সর্বশেষ ১৬টি সংগঠনের মোট ১ হাজার ১৮১ জনকে গ্রেফতার করে। এগুলোর মধ্যে জেএমবির সদস্যই ৬১০ জন, হিজবুত তাহরিরের ২৪৪ জন, হিজবুত তাওহিদের ১৪৪ জন, হুজিবির ৯০ জন, বিইএমের ৩ জন, ইসলাম ও মুসলিমের ৬ জন, জয়েস-ই-মোহাম্মদের ৮ জন, আল্লাহর দলের ৮ জন, হিজবুল মুজাহীদীনের ১ জন, লস্কর ই-তৈয়বার ৬ জন, খেলাফত মজলিসের ২ জন, উলফা সদস্য ২ জন, তাসাউফ মহলের ১০ জন, আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের ৯ জন, শহীদ হামজা ব্রিগেডের ৩২ জন।র‌্যাব সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে র্যাবের পক্ষ থেকে হিজবুত তাওহিদসহ অন্য জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়া হয়। যদিও আনসারুল্লাহ বাংলাটিমকে নিষিদ্ধ করা হয় তবে হিজবুত তাওহিদকে নিষিদ্ধ করা আরো বেশি জরুরি।এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জাগো নিউজকে বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলো আধুনিক যুবকদের টার্গেট করে কৌশলী হয়ে গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের ধরতে র‌্যাব আরো বেশি সক্রিয়। র‌্যাব প্রায় ১ হাজার ২০০ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বেশি লক্ষ্য করা যায় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে নজরদারি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ২০০৯ সালের ২০ এপ্রিল গঠন করা হয় জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার কমিটি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে সদস্য হিসেব রাখা হয় স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, আইন, ধর্ম, সমাজকল্যাণ, স্থানীয় সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। এছাড়া পুলিশ, ডিজিএফআই, বিজিবি, আনসার ও ভিডিপি, মহাপরিচালক (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়), র‌্যাব প্রধান, পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবও সদস্য।  ২০১৩ সালের জুনের বৈঠকে আরো বেশ কয়েকটি সংগঠনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়। সেগুলো হলো জামিউতুল ফালাহ, ইসলামিক সলিডারিটি ফ্রন্ট, আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, আরাকান পিপলস আর্মি, আরাকান মুজাহিদ পার্টি, মিয়ানমার লিবারেশন ফোর্স, রোহিঙ্গা লিবারেশন ফোর্স, রোহিঙ্গা ইনডিপেন্ডেন্স পার্টি, রোহিঙ্গা প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট, মুসলিম মিল্লাত, আল হারাত-আল-ইসলামিয়া, ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্ট, তৌহিদী জনতা, জুমা`আতুল আল সাদাত, তামিরউদ্দীন দ্বীন বাংলাদেশ, আল খিদমত, হিজবুল মাহদি, হিজবুল্লাহ ইসলামী সমাজ, দাওয়াতি কাফেলা, বাংলাদেশ এন্টি টেররিস্ট পার্টি, আল মারকাজুল আল ইসলামী, আল ইসলাম মার্টেনস ব্রিগেড, সত্যবাদ, মুসলিম মিল্লাত, শরিয়া কাউন্সিল, জমিয়ত আহলে হাদিস আন্দোলন, আহলে হাদিস আন্দোলন বাংলাদেশ, তাজির বাংলাদেশ, হায়াতুর ইলাহা, ফোরকান মুভমেন্ট, জামিউতুল এহজিয়া এরতাজ, আনজুমানে তালামিজ ইসলামিয়া, কলেমার জামাত, সাহাবা পরিষদ, কাতেল বাহিনী, মুজাহিদিন-ই-তাজিম, এশার বাহিনী, আল ফাহাদ, হরকাতুল মুজাহিদিন ও জাদিদ আল কায়দা। সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল ‘জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার’ কমিটির পঞ্চম সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত হয়। মাদ্রাসার কোরআন, হাদিস, সংবিধান এবং জাতীয় চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয় ও কোনো রাজনৈতিক দল সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধ বা রচনা প্রভৃতি বাদ দেয়া, এসব বিষয় চিহ্নিত করতে কমিটি গঠন এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে বৈঠকের পৃথক নির্দেশনা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. আহমদ জিয়াউদ্দিন বলেন, ২০০৫ সালের ৭ আগস্ট সিরিজ বোমার হামলা চালিয়ে জেএমবি শক্তি প্রদর্শন করে। যদিও এর আগেই জঙ্গি সংগঠনগুলোর উৎপত্তি। জেএমবির সেই সিরিজ হামলার এক দশক পরও জঙ্গিবাদের প্রকৃত অবস্থা বদলায়নি। বরং দিনের পর দিন কৌশলী হচ্ছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। দেশ থেকে ‘জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে’ এমন দাবি করা তাই অমূলক। চেতনা বিনাশ করতে হবে। জঙ্গিবাদের যে চেতনা ছড়িয়ে যাচ্ছে তা বন্ধ না করা গেলে জঙ্গিবাদ নির্মূল হওয়ার নয়।জেইউ/বিএ/এমএস

Advertisement