‘আচ্ছা প্রিমিয়ার লিগে শেষ কবে জাতীয় ক্রিকেটারদের প্রায় ৯৯ ভাগ শুরু থেকে খেলেছেন?’ এ প্রশ্নর উত্তর দিতে গিয়ে ধাঁধাঁয় পড়েছেন অনেকেই। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের সঙ্গে প্রায় তিন যুগ যার নাড়ীর সম্পর্ক, সেই অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক সারোয়ার ইমরান এবং সময়ের অন্যতম সিনিয়র ক্রিকেটার আব্দুর রাজ্জাক কিছুতেই মনে করতে পারলেন না ঠিক কবে তারকা ও জাতীয় ক্রিকেটারদের প্রায় সবাই ঢাকা লিগের শুরু থেকে খেলেছেন। শুধু ওই দুজনার কথা বলা কেন? ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের খুঁটিনাটি যাদের নখদর্পনে এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলেই মেলেনি এর সত্যিকার উত্তর। কারণ, ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকেই আসলে ঢাকা লিগে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ অনিয়মিত এবং কম। বেশিরভাগ সময় তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়েছে জাতীয় দলের কার্যক্রম নিয়ে। কখনো বিদেশে আবার কখনও হোম সিরিজ খেলার কারণে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের একটা বড় অংশ এক যুগের বেশি সময় ধরে ঢাকা লিগে পুরো সময় দিতে পারেননি। হয় শুরুতে কয়েক ম্যাচ খেলার ফুরসত মিলেছে। না হয় শেষ অংশে দু’তিনটি ম্যাচ খেলা হয়েছে। এবার সে ধারার ব্যতিক্রম। এমনকি অনেক কারণেই এবারের ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট অন্যরকম! এ যেন মরা গাঙ্গে হঠাৎ বাণ ডাকার মত। দীর্ঘদিন পর শুরু থেকেই তারকা ক্রিকেটারদের সরব উপস্থিতি। জাতীয়দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে দু‘জন (মুস্তাফিজুর রহমান, সাকিব আল হাসান পরে এসে যোগ দিয়েছেন) কেবল নেই। তারা ভারতে- আইপিএল খেলতে গিয়েছিলেন। এছাড়া বর্তমান ও অতীত মিলে যাদের গায়ে জাতীয় দলের জার্সি উঠেছে, তাদের প্রায় ৯৯ ভাগই এবারের প্রিমিয়ার লিগের শুরু থেকে ব্যাট এবং বল হাতে মাঠ মাতাচ্ছেন। ফলে আকর্ষণও বেড়ে গেছে বহুগুনে। গ্যালারিতে দর্শক উপস্থিতি না বাড়লেও মাঠের লড়াই জমেছে বেশ। প্রতিদ্বন্দ্বীতাও বেড়েছে বহুগুনে। তার প্রমান লিগ টেবিল। প্রথম পর্যায়ের ৭ রাউন্ড শেষ- অথচ বলা যাচ্ছে না কোন ৬ দল সুপার সিক্স খেলবে? অন্য যে কোন বছর এ সময়ে লিগের চাল-চিত্র অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। ৪/৫ ম্যাচ পর কিছু দল অন্যদের টপকে ওপরে চলে যায়। এবারো যে কেউ যায়নি, তা নয়। গেছে; কিন্তু মোহামেডান আর প্রাইম দোলেশ্বর ছাড়া সুপার সিক্সের দৌড়ে আর কেউ তেমন এগিয়ে নেই। মুশফিকুর রহিমের সাদা কালো শিবির ( যদিও এবারের জার্সির রং সবুজাভ) আর ফরহাদ রেজার প্রাইম দোলেশ্বর সাত খেলায় সমান পাঁচটিতে জিতে যৌথভাবে ১০ পয়েন্ট নিয়ে সবার ওপরে। এই দু দলের সেরা ছয়ে থাকা মোটামুটি নিশ্চিত। বাকি চার স্থানের জন্য তীব্র লড়াই- ভিক্টোরিয়া, লিজেন্সড অব রুপগঞ্জ, গাজী গ্রুপ, প্রাইম ব্যাংক, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও আবাহনীর মধ্যে। এই ছয় দলের মধ্যে (২৬ মে পর্যন্ত) নাদিফ চৌধুরীর ভিক্টোরিয়া (৭ খেলায় ৯ পয়েন্ট) আর মোশাররফ হোসেন রুবেলে রুপগঞ্জ (৭ খেলায় ৯) বাকিদের চেয়ে একটু সুধিাজনক জায়গায়। শাহরিয়ার নাফীসে কমলা রঙ্গের ব্রাদার্স, অলক কাপালির গাজী ট্যাংক, শুভাগত হোমের প্রাইম ব্যাংক ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের শেখ জামাল সমান সমানে (চার দলেরই পয়েন্ট ৭ খেলায় ৮ করে)। সে তুলনায় তামিম ইকবালের আবাহনী খানিকটা পিছিয়ে। আকাশী-হলুদ জার্সিধারিদের পয়েন্ট ৭ খেলায় ৬। এখন অপেক্ষা শেষ ৪ রাউন্ডের। সেখানেই জানা যাবে কোন ছয় দল শেষ পর্যন্ত সুপার সিক্স খেলবে? নীচের দিকে থাকা তিন দল কলবাগান ক্রীড়া চক্র (সাত খেলায় ৪), সিসিএস (সাত খেলায় ২) আর কলাবাগান ক্রিকেট একাডেমিকে (সাত খেলায় ২) ওপরে উঠতে হলে অবশ্যই পরের রাউন্ড গুলোয় অতি নাটকীয়তার জন্ম দিতে হবে। বড় ধরনের চমকও দেখানো প্রয়োজন। অন্যথায় হয়ত তলানিতেই থাকতে হবে। এক সময় বাংলাদেশের ক্রিকেট ছিল ঢাকার ক্লাব কেন্দ্রিক। অনেকেই এ আসরকে বলতেন ‘হারাধনের একটি ছেলে।’ সত্যিই তাই। বাংলাদেশের ক্রিকেট উত্তরনে এ লিগের ভুমিকা অপরিসীম। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার আগে এই একটি লিগের ওপরই ভর করেছিল দেশের ক্রিকেট। রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব ক্রিকেটারের স্বপ্নের আসর ছিল ঢাকা লিগ। জাতীয় দলে খেলার সিঁড়ি হিসেবেই হোক আর জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন হিসেবেই হোক- ক্রিকেটারদের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক ছিল এই লিগ; কিন্তু জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরুর পর থেকেই সে ধারায় ছেদ পড়লো। এখন সারা বছরই- আজ এখানে তো কাল ওখানে টেস্ট, আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলায় ব্যস্ত হয়ে ওঠা। সুতরাং, ঢাকা লিগের গুরুত্ত¡ও কমে যেতে শুরু করলো। একদিনের সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলে পাঁচ দিনের টেস্টে ভাল করা সম্ভব নয়- এ বাস্তব বোধ ও উপলব্ধি থেকেই দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট চর্চায় মনোযোগি হওয়া। প্রথমত: ক্রিকেটারদের জাতীয় দলে ব্যস্ত হয়ে ওঠা। পাইপ লাইন ঠিক রাখতে তার পরের ক্যাটাগরির ক্রিকেটারদের একাংশ নিয়ে কখনো ‘এ’ দল আবার কখনও একাডেমি কিংবা ডেভলপমেন্ট স্কোয়াড গঠন। সব মিলে ঢাকা লিগে ধীরে ধীরে তারকার ঘাটতি শুরু হয়। এবার অনেকদিন পর সবাই একসঙ্গে খেলার সুযোগ পাওয়ায় পুরো লিগেরই বাতাবরণ পাল্টে গেছে যেনো। একটা নতুন প্রানের সঞ্চার হয়েছে। যেহেতু জাতীয় দলের কোন এ্যাসাইনমেন্ট নেই। তাই জাতীয় তারকারা শতভাগ মনোযোগ এবং মনোসংযোগ দেয়ার অবকাশ পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা জাতীয় দলে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্যও এই লিগটা এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই হয়তো দেখা যাচ্ছে, শুধু সীমিত ওভারের ফরম্যাটে জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফিও বল ও ব্যাট হাতে দূর্বার। সাত খেলায় ১২ উইকেট শিকারের পাশাপাশি নড়াইল একসপ্রেস ঢাকা লিগে ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরিও করে ফেলেছেন। বাংলাদেশের কেউ যা পারেননি কখনো, মাশিরাফি এবার তাই করে দেখালেন। শেখ জামালের বিরুদ্ধে ৫০ বলে শতরান করে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে লিস্ট ‘এ’তে দ্রুততম শতরানের মালিক এখন মাশরাফি। শুধু মাশরাফিই নন। ব্যাট হাতে জ্বলে উঠেছেন শাহরিয়ার নাফীস, শামসুর রহমান শুভ ও তুষার ইমরানের মত অভিজ্ঞ পারফরামাররাও। বয়স কোন বাধা নয়, ৭ খেলায় একটি করে সেঞ্চুরি ও হাফ সেঞ্চুরিতে ৩২১ রান করে তার প্রমান দিলেন বাঁ-হাতি শাহরিয়ার নাফীস। প্রায় সাবেক হয়ে পড়া পেসার মোহাম্মদ শরীফও কম যাননি। মধ্য তিরিশে পৌছেও দুর্দান্ত শেখ জামালের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিকে শিরোনাম হয়েছেন গাজী গ্রুপের এ পেসার। এছাড়া ব্রাদার্সের হয়ে নিয়মিত রান করেছেন তুষার ইমরান। রান তোলায় এক নম্বরে জায়গা করে নিতে না পারলেও ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলে সবার নজর কেড়েছেন তিন স্থানীয় ক্রিকেটার- ভিক্টোরিয়ার নতুন আবিষ্কার আল আমিন (৩৭৪), গাজী গ্রুপের এনামুল হক বিজয় (৩৮৪) ও শামসুর রহমান শুভ (৩৪৫)। এর মধ্যে আল আমিন ও শামসুরের ব্যাট থেকে সাত খেলায় সর্বাধিক চারটি করে হাফ সেঞ্চুরি বেরিয়েছে। একই কৃতিত্বেও অধিকারি মোহামেডানের বাঁ-হাতি লঙ্কান ওপেনার উপল থারাঙ্গাও। সব মিলে জমজমাট লড়াই হচ্ছে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। সব শ্রেনীর ক্রিকেটারদের ভাল খেলার তাগিদ, ইচ্ছে ও সংকল্প বেশি থাকায় শক্তির তারতম্যও কমে গেছে। কাগজে কলমে যাদের বেশি সমৃদ্ধ মনে হচ্ছিল, মাঠের লড়াইয়ে সেই কাতারের অন্যতম শিবির আবাহনী তাই পিছনে। তামিম, মোসাদ্দেক , নাজমুল শান্ত, তাসকিন, আবুল হাসান রাজু ও সাকলাইন সজিবদের নিয়েও ধানমন্ডির দল তাই পিছিয়ে (যদিও সাকিব যোগ দেয়ার পর জয়ে ফিরেছে আবাহনী)। আর অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম- শ্রীলঙ্কান উপল থারাঙ্গার চওড়া ব্যাটে কাগজে কলমে চার-পাঁচ নম্বর দল মোহামেডান এখন সবার ওপরে। চার স্পিনার নাইম জুনিয়র, এনামুল জুনিয়র (দুজনই ৭ খেলায় ১৩ উইকেট), হাবিবুর রহমান (১২) আর নাইমের সঙ্গে সবেধন নীলমনি পেসার শুভাশীষের (১০ উইকেট) বোলিং কার্যকরিতায় মোহামেডান পেয়েছে আশাতীত সাফল্য। অন্যদিকে ওপেনার ইমতিয়াজ হোসেন তান্নার দুর্দান্ত ব্যাটিং আর অধিনায়ক ফরহাদ রেজা (১০) ও পেসার আল আমিনের (৭ খেলায় ১৩ উইকেট) নজরকাড়া পারফরমেন্সে লিগ টেবিলে মোহামেডানের সঙ্গে সমান্তরালে প্রাইম দোলেশ্বর। জিম্বাবুয়ান হ্যামিল্টন মাসাকাদজা দুই সেঞ্চুরিসহ ৭ খেলায় সবার চেয়ে বেশী ৪১৯ রান করলেও তার দল কলাবাগান ক্রীড়া চক্র রয়েছে নীচের সারিতে। মাসাকাদজার সমান দুই শতক সহ দ্বিতীয় সর্বাধিক ৪০৪ রান করা ইমতিয়াজ হোসেন তান্নার ব্যাটিংটা পূর্নতা পেয়েছে দলের বোলারদের সাফল্যে। সেই ১০ বছর আগে জুনায়েদ সিদ্দিকীর সঙ্গে মোহামেডানের হয়ে ওপেন করা সিলেটের তান্না এবার ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলে এখন পর্যন্ত স্থানীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে রান তোলায় সবার ওপরে। তবে সর্বাধিক স্কোরারের মত সর্বাধিক উইকেট শিকারীও একজন বিদেশী; চামারা সিলভা। ভিক্টোরিয়ার এ বাঁহাতি স্পিনারের ঝুলিতে জমা পড়েছে ১৯ উইকেট। অবশ্য তার ঠিক পেছনে পাঁচ উদ্যমী তরুণ, আবাহনীর লেগস্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখন, মোহামেডানের দুই বাঁহাতি স্পিনার নাইম ও এনামুল জুনিয়র, দুই পেসার পেসার আল আমিন (প্রাইম দোলেশ্বর) ও কামরুল ইসলাম রাব্বি। তাদের প্রত্যেকের উইকেট সংখ্যা ১৩টি করে। ব্যাট ও বল হাতে সবচেয়ে নজরকাড়া অলরাউন্ড পারফরমেন্স শেখ জামাল অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। সাত খেলায় ২৯৬ রান তোলা মাহমুদউল্লাহ রান সংগ্রহে ১১ নম্বর। এ অফস্পিনারের ঝুলিতে ১১ উইকেটও জমা পড়েছে। এবারের ঢাকা লিগে এখনও পর্যন্ত শতরান হয়েছে ১৯টি। মাসাকাদজা আর ইমতিয়াজ তান্না দুটি করে শতক হাঁকিয়েছেন।
Advertisement
* এই নিবন্ধে উল্লিখিত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সমস্ত পরিসংখ্যান ২৬মে ২০১৬ পর্যন্ত।জাগো নিউজের বিশেষ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন জাগো চ্যাম্পিয়ন পড়তে এখানে ক্লিক করুন...আইএইচএস/এবিএস