ক্যাম্পাস

ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজ

নিজেকে জানো- এই নীতিবাক্য বিশ্বাসী ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ইতিহাসের সাক্ষী দেশের এই শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। ১৮৪১ সালের ১৮ জুলাই উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা কলেজ।ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৩৫ সালের ২০ এপ্রিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন লর্ড বেন্টিকের কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করে; যেখানে বলা হয়: সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রধান প্রধান জনবহুল শহরে ইংরেজি সাহিত্য এবং বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক।পরবর্তীকালে এ প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকার কর্মকর্তাদের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হলে ঢাকার সে সময়ের সিভিল সার্জন ডা. জেমস টেইলার জানান, এখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব সুবিধা (আর্থিক এবং সামাজিক) পাওয়া যাবে। মূলত তখন থেকেই শুরু হওয়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি, যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত।এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতে একদিকে যেমন বদলে যেতে থাকে সমাজের সামগ্রিক চালচিত্র, তেমনি বিদ্যার্থীদের মানসসম্মুখে পাশ্চাত্যের কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান এবং দর্শন উন্মোচিত হতে থাকে। শিক্ষা এবং সমাজব্যবস্থার এ ইতিবাচক পরিবর্তনে সে সময়ের গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কতগুলো কেন্দ্রীয় কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।এর প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত ব্যয়ের কথা উল্লেখ এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা তার যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে ১৮৪১ সালে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়, যার নাম দেয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুলের নাম দেওয়া হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। এ কলেজ প্রতিষ্ঠার পরপরই বদলে যায় সমগ্র ঢাকার চালচিত্র। ঢাকা হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ববাংলার ইংরেজি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র।কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে. আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়।১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা আধুনিক বাংলার ইতিহাসে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তেমনি ঢাকা কলেজের জন্যও এক অভাবনীয় ঘটনা। কেননা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরপরই ঢাকা কলেজকে এর অধিভুক্ত করা হয়। সে সময় থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণ করতে থাকেন ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। ১৮৫৬ সালে গণিতশাস্ত্রের পণ্ডিত অধ্যাপক ব্রেনান্ডকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয়।এরপর সিপাহী বিদ্রোহের অবসানের পর দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে বা অর্থনৈতিক অবস্থা সচ্ছল হতে বেশ সময় লাগে। যে বাড়ি দুটিতে কলেজের কার্যাবলী সাময়িকভাবে পরিচালিত হচ্ছিল, তাও ছিল বেশ অনুপযোগী। এরপরও ১৮৫৯-৬০ সালে কলেজের ছাত্রসংখ্যা বেড়ে ৫১ জনে দাঁড়ায়।পূর্ববঙ্গের স্কুল-কলেজ পরিদর্শক তার ১৮৫৯-৬০ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, ঢাকা কলেজে যে কোর্স পড়ানো হয়, তা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পরীক্ষার কোর্সের সমতুল্য এবং কোর্স শেষে ছাত্রদের জ্ঞানের পাঁচটি শাখায় পরীক্ষা দিতে হয়। এ পাঁচটি বিষয় ছিল- ইংরজিসহ দুটি ভাষা, ইতিহাস এবং ভূগোল, অঙ্ক, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা) এবং মানসিক নৈতিক বিজ্ঞান।১৮৭৫ সালে ঢাকা কলেজ একটি বড় সম্মান লাভ করে: সে বছর ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান শাখা খোলা হয়, অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়ক নতুন নতুন বিষয় পড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকা কলেজে পড়তে আসা ছাত্রদের তথ্য প্রথম পাওয়া যায় ১৮৪৩ সালে।সে বছর কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায় যে, ১৫ জন ছাত্র বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে সাতজন ফরিদপুর, দু’জন বরিশাল, দু’জন যশোর, দু’জন ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলেন। এছাড়া ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকেও ভর্তি হয়েছিলেন দুই ছাত্র।তবে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজে কোনো ছাত্রাবাস গড়ে ওঠেনি। এ দীর্ঘ সময়ে ছাত্ররা তাই নানাবিধ কষ্টের মধ্যেই তাদের জীবন অতিবাহিত করেন। যদিও ১৮৭৪ সালে ঢাকায় একটি ছাত্রাবাস গড়ে ওঠে, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।পরবর্তীতে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে ১৮৮০ সালে ঢাকা কলেজের জন্য বাংলাবাজারের শ্রীদাস লেনে রাজচন্দ্র হিন্দু ছাত্র হোস্টেল নামে প্রথম ছাত্রাবাস নির্মিত হয়। এরপর হোস্টেলের ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ১৮৮৩-৮৪ সালে বোর্ডারের সংখ্যা ৯০-এ দাঁড়ায়।১৯০৪ সালের ২৭ মে এক সরকারি সভায় ঢাকা কলেজের জন্য একটি আধুনিক ছাত্রাবাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।এরপর সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে নতুন দুটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এতে বহু ছাত্র উপকৃত হন। হোস্টেলের নাম রাখা হয়- সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেল। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজের হিন্দু হোস্টেল রূপান্তরিত হয়ে হয় ঢাকা হলে, যা বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল এবং সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের মুসলিম হোস্টেলটি হয়ে যায় মুসলিম হল, যা বর্তমানে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল।বর্তমানে ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এবং শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাঙ্গন। এর ছাত্রসংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। এখানে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১৯টি বিষয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু রয়েছে। ছাত্রদের জন্য ঢাকা কলেজে সাতটি ছাত্রাবাস আছে।

Advertisement

এএস/এনএফ